রক্তের ফেরিওয়ালা 'সন্ধানী'

ডক্টর টিভি রিপোর্ট
2022-02-05 20:21:49
রক্তের ফেরিওয়ালা 'সন্ধানী'

রক্তের প্রয়োজন হলেই হাত বাড়িয়েছে সন্ধানী

মানবতার সেবায় কাজ করে যাওয়া স্বাধীনতা পুরষ্কার পাওয়া 'সন্ধানীর' ৪৫ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী আজ। নানান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হলো দিবসটি। আজ থেকে ৪৫ বছর আগে জন্ম নেয়া এ সংগঠনটি অসহায় মানুষের রক্তের চাহিদা পুরণ করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় তাদের চক্ষুদান কর্মসূচির মাধ্যমে অনেক অন্ধ মানুষ পেয়েছে দেখার সৌভাগ্য।

সন্ধানীর জন্ম কিন্তু খুব মজার। ১৯৭৭ সাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন মোঃ ইদ্রিস আলী মঞ্জু। একদিন তিনি জানতে পারে, তাদের এক সহপাঠী আর্থিক সমস্যার কারনে সকালের নাস্তা না করে অভূক্ত অবস্থায় দুপুর দুটা পর্যন্ত ক্লাস করেন। বিষয়টি তাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দেয়। ১৯৭৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে নাস্তার টেবিলে ব্যাপরটি তিনি আরো পাঁচ জন সহপাঠীকে জানান। সবাই মিলে পরিকল্পনা করতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সম্মুখস্থলের কড়ই গাছের নিচে একত্রিত হন।

আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো তারা ছয়জন মিলে ঐ সহপাঠির সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করবেন। ঠিক হয়, প্রতিমাসে একজন দিবেন সাত টাকা, বাকি পাঁচ জনে পাঁচ টাকা করে। প্রথম মাসে তাদের সংগ্রহ ছিল বত্রিশ টাকা। সে সময় ত্রিশ টাকায় পুরো মাসের সকালের নাস্তা হয়ে যেতো। এভাবে নামহীনভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ১৯৭৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু হয় সন্ধানী।

সহপাঠীকে সাহায্যের বিষয়টি তাদের ভাবিয়ে তুলে। এমন আরো শত শত অসহায় শিক্ষার্থী ও হাসপাতালের রোগীদের কথা চিন্তা করে তারা তাদের কাজটিকে একটি সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন।

১৯৭৭ সালের ১৯ মার্চ বিকাল ৫ টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যেকে সংগঠনের একটি করে নাম ঠিক করে একত্রিত হন। কয়েকটি প্রস্তাবিত নামের মধ্য থেকে মোশাররফ হোসেন মুক্ত'র প্রস্তাবিত ‘সন্ধানী’ নামটি সবাই সংগঠনের জন্য মনোনীত করেন। পাশাপাশি গঠিত হয় প্রথম কমিটি। কমিটির সদস্যরা ছিলেন, মোস্তাফিজুর রহমান স্বপন (সভাপতি), মোশাররফ হোসেন মুক্ত (সাধারণ সম্পাদক), মোঃ ইদ্রিস আলী মঞ্জু (অর্থ সম্পাদক), খুরশিদ আহমেদ অপু (সাহিত্য, পত্রিকা ও প্রকাশনা সম্পাদক), মোস্তফা সেলিমুল হাসনাইন (পাঠাগার সম্পাদক) এবং মোঃ আব্দুল কাইউম (সাংগঠনিক সম্পাদক)।

পরবর্তীতে ছয় জন মিলে তৈরি করে সন্ধানীর প্রথম সংবিধান ‘সন্ধানী নিয়মাবলী’। যেখানে সন্ধানীর উদ্দেশ্য হিসেবে লেখা ছিল- ‘যাবতীয় অন্যায় অনাচার থেকে মুক্ত রেখে নিজেদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা এবং মানবতার কল্যাণের জন্য সাধ্যানুযায়ী সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।'

১৯৭৯ সালের ১৮ অক্টোবর স্বতন্ত্র ইউনিট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় সন্ধানী ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ইউনিট। সন্ধানীয়ানদের কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। ১৯৮২ সালের মধ্যে সন্ধানী ইউনিট প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল এবং ঢাকা ডেন্টাল কলেজে।

১৯৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে ৯টি ইউনিট নিয়ে গঠিত হয় সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ। পাশাপাশি সহযোগী সংগঠন হিসেবে ১৯৮২ সালের ২ জুলাই ‘সন্ধানী ডোনার ক্লাব’ এবং ১৯৮৪ সালের ২৫ নভেম্বর ‘সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি’ ও ‘সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

সন্ধানী দেশের প্রথম স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি ১৯৭৮ সালের ২রা নভেম্বর আয়োজন করে। এ মহতী উদ্যোগের স্বীকৃতি স্বরূপ এবং স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান কর্মসূচিকে সামাজিক আন্দোলনে রূপদানের লক্ষ্যে ১৯৯৫ সাল থেকে ২রা নভেম্বরকে ‘জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস’ হিসেবে পালন করার ঘোষণা দেয় সরকার।

সন্ধানীকে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৩ সালে স্বীকৃতি দেয়। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সমাজ কল্যাণ পরিষদ ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর অনুমোদন প্রদান করে। একই বছর এশিয়ার একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে সন্ধানী পায় ‘কমনওয়েলথ ইয়ুথ সার্ভিস এওয়ার্ড'। ২০০৪ সালে ‘সমাজসেবা’ ক্যাটাগরিতে ছাত্র-ছাত্রী পরিচালিত বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে সন্ধানী অর্জন করে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ‘স্বাধীনতা পদক’।

 


আরও দেখুন: