মানবদেহে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপন কেন যুগান্তকারী?
যুগান্তকারী এই চিকিৎসাপদ্ধতি যে শুধুই কল্পনার বিষয় নয়, সম্প্রতি বাস্তবে তা প্রমাণ করে দেখালেন বার্মিংহামের আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের শল্য চিকিৎসকরা।
জিনগতভাবে উপযোগী করে মানবদেহে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপনের কাঙ্ক্ষিত এক মাইলফলক স্পর্শ করেছে চিকিৎসাবিজ্ঞান। এই সফলতাকে যুগান্তকারী বলছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু কেন?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, অন্য প্রাণীর কিডনিকেও এখন মানুষের শরীরের উপযোগী করে প্রতিস্থাপন করা যাবে সফলভাবেই।
যুগান্তকারী এই চিকিৎসাপদ্ধতি যে শুধুই কল্পনার বিষয় নয়, সম্প্রতি বাস্তবে তা প্রমাণ করে দেখালেন বার্মিংহামের আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের শল্য চিকিৎসকরা।
জিনগতভাবে উন্নত করা শূকরের দু’টি কিডনিকে তারা নিখুঁতভাবে মানবদেহে প্রতিস্থাপিত করেছেন। আর অন্য প্রাণীর সেই কিডনি দু’টিকে মেনে নিতে মানবশরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা কোনো বাধা দেয়নি।
যুগান্তকারী এই কিডনি প্রতিস্থাপনের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক চিকিৎসাবিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘আমেরিকান জার্নাল অব ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন’-এর ১৯ জানুয়ারি সংখ্যায়।
এই পদ্ধতি নিয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরুর জন্য আমেরিকার ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন' (এফডিএ)-এর অনুমোদনও মিলেছে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, ‘এই সফল প্রতিস্থাপন চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এর ফলে, কিডনি তো বটেই, মানবদেহের বিকল হয়ে যাওয়া বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পরিবর্তে অন্য প্রাণীর অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সব জটিলতা দূর হওয়ার পথ খুললো।’
তাদের মতে, ‘প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অপ্রতুলতা আর শল্য চিকিৎসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। কিডনিসহ বিভিন্ন প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গের অভাবে মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা অনেকটাই কমানো সম্ভব হবে।’
আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডায়াবিটিস অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড কিডনি ডিজিজেজ’-এর দেওয়া পরিংসখ্যান অনুযায়ী, স্তন বা প্রস্টেটের ক্যান্সারে বিশ্বে প্রতি বছর যত মানুষের মৃত্যু হয়, কিডনির বিভিন্ন অসুখে মৃত্যুহার তার চেয়ে অনেক বেশি।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়। মূল সমস্যা হয় প্রতিস্থাপনযোগ্য মানুষের কিডনির অপ্রতুলতা।
এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের কাছে একমাত্র কাম্য হয়ে ওঠে অন্য প্রাণীর কিডনি। অন্য প্রাণীর কিডনি মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপনের পদ্ধতিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, ‘জেনোট্রান্সপ্ল্যান্টেশন’।
কিন্তু এই পদ্ধতির কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিল। তাই গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে শিম্পাঞ্জির কিডনি মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা সফল হয়নি। শিম্পাঞ্জি মানুষের অনেক কাছের প্রজাতি হওয়া সত্ত্বেও।
ওই সময় যে ১৩ জন কিডনি রোগীর দেহে শিম্পাঞ্জির কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল, তাদের ১০ জনেরই মৃত্যু হয়েছিল দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে। কারণ, মানুষের দেহের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা শিম্পাঞ্জির কিডনি মেনে নিতে চায়নি। তাই সেই কিডনি মানুষের শরীরে বেশি সময় ধরে কাজও করতে পারেনি।
আটের দশকের গবেষণায় বিজ্ঞানী, চিকিৎসকদের এই ধারণা জন্মায়, শূকরের কিডনি হয়তো মানুষের শরীর মেনে নেবে। কারণ, আকারে, আকৃতিতে শূকরের কিডনি অনেকটাই মানুষের কিডনির মতো। আটের দশকে এক রোগীর দেহে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপিতও করা হয়। কিন্তু ৫৪ ঘণ্টার বেশি তা সক্রিয় থাকেনি।
এর কারণ ছিল, মানবদেহের আরও নানা ধরনের প্রতিরোধ অন্য প্রাণী থেকে নেওয়া অঙ্গের বিরুদ্ধে। তার মধ্যে অন্যতম, মানবরক্তের ‘ব্লাড ক্লটিং’। মানব রক্তের চাপ শুকর বা অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে বেশি। সেই বাড়তি চাপ নিতে পারেনি শূকর থেকে প্রতিস্থাপিত কিডনি।
এবার গবেষকরা শুকরের কিডনির ১০টি জিনকে আলাদাভাবে সম্পাদনা করে নিয়েছিলেন গবেষণাগারে, যাতে সেগুলো মানবদেহে প্রতিস্থাপনের পর একেবারে মানুষের কিডনির মতোই কাজ করে। সেই কিডনিকে যেন মানবদেহের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাইরের শত্রু বলে মনে না করে। যেন সেই কিডনি মানবরক্তের ‘ব্লাড কটিং’ না ঘটায়, রক্ত সংবহন যেন অব্যাহত থাকে মানবদেহে।
বার্মিংহামের আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের মারনিক্স ই হিরসিঙ্ক স্কুল অব মেডিসিনের ট্রান্সপ্ল্যান্ট ইনস্টিটিউটের কমর্ককর্তা জেমি লকের নেতৃত্বে একটি গবেষকদল জিনগতভাবে উন্নত করা শূকরের দু’টি কিডনি এক মৃত্যুপথযাত্রীর দেহে বসিয়ে দেন। ওই রোগীর কিডনি দু’টি একেবারে বিকল ছিল।
এরপর যতক্ষণ সেই রোগী বেঁচেছিলেন, টানা ৭৭ ঘণ্টা ধরে একেবারে মানুষের কিডনির মতোই কাজ করতে দেখা গেছে শুকরের জিনগতভাবে উন্নত করা দু’টি কিডনিকে।
ওই রোগীর নাম জিম পার্সনস। তিনি চেয়েছিলেন মৃত্যুর পর তার অঙ্গগুলো যেন অন্য মানুষের সেবায় কাজে লাগে। তার কিডনি সেই কাজ করতে পারেনি বটে, তবে তার শরীরেই সম্ভব হয়েছে এই সফল কিডনি প্রতিস্থাপন। তারই স্বীকৃতি হিসেবে গবেষকরা এই পদ্ধতির নাম দিয়েছেন- ‘দ্য পার্সনস মডেল’।