‘আমি খুব ক্ষুদ্র মানুষ, প্রশংসা না করলে খুশি হব’
দুনিয়াতেই আমার কাজের সব সম্মান পেয়ে গেলে পরকালে আল্লাহর থেকে কিছুই পাব না
প্রখ্যাত কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমি খুবই ক্ষুদ্র মানুষ। বক্তৃতার সময় আমার নাম একবারের বেশি উচ্চারণ না করলে আমি খুব খুশি হব।’
শুক্রবার (১৪ জানুয়ারি) রাতে রাজধানীর অফিসার্স ক্লাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে-৪০ ব্যাচের সহপাঠীদের দেওয়া সম্মাননা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।
অধ্যাপক কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সব সময় চাই বাংলাদেশ যেন এগিয়ে যায়। দেশের জন্যই সব সময় কাজ করার চেষ্টা করেছি। যখনই কোনো দেশে গিয়েছি, উন্নত প্রযুক্তি ও চিকিৎসা যা দেখেছি, সেটি কীভাবে আমাদের দেশে নিয়ে আসা যায়, আমি সেই চেষ্টা করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সম্মাননা অনুষ্ঠানে দয়া করে কেউ আমার প্রশংসা করবেন না। দুনিয়াতেই যদি আমার কাজের সব সম্মান পেয়ে যাই, তাহলে পরকালে আল্লাহর থেকে কিছুই পাব না।’
দেশে এখন পর্যন্ত মরণোত্তর অঙ্গ প্রতিস্থাপন শুরু না হওয়ায় কিছুটা হতাশা প্রকাশ করেন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ প্রণয়ন করা হয়। এর পর দীর্ঘ সময়েও আইনটি বাস্তাবায়ন করা যায়নি। একজন সদ্যমৃত ব্যক্তির অঙ্গ দিয়ে ১৪ জন মৃত্যুপথযাত্রীর জীবন বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। মরণোত্তর অঙ্গ রোগীর দেহে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে রোগী ফিরে পেতে পারে সুস্থ জীবন।
তবে ২০১৮ সালে আইনটি সংশোধন হয়। এই বছরের মধ্যে মরণোত্তর দান করা অঙ্গ প্রতিস্থাপন সম্ভব হবে হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন ডা. কামরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট অনেক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার বিশ্বাস, আমরা সবাই মিলে কাজ করলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। সবকিছু ঠিক থাকলে সিকেডি অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল মরণোত্তর অঙ্গদান শুরু করা হবে।’
বিনামূল্যে সহস্রাধিক কিডনি প্রতিস্থাপন করে শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও জায়গা করে নিয়েছেন অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। নিভৃতচারী এ গুণী মানুষটিকে সহকর্মী ও বন্ধুরা সম্মাননা জানান।
অনুষ্ঠানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলামের এক সময়ের সহপাঠী শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব ডা. মেজবাহ উদ্দিন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমরা স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ এত বড় একটা পৃথিবীতে তিনি আমাদের ডা. কামরুলের সাহচর্য পাওয়া, একইসাথে একই ব্যাচে পড়ার সুযোগ দিয়েছেন। কামরুলের মতো হয়ত এতটা গুণী আমরা নই, কিন্তু তার সাথে একত্রে পড়াশোনা করা, একসাথে চলার সুযোগ আমাদের হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি ডাক্তার হয়েছি, কিন্তু একজন ভালো মানুষ হতে পেরেছি কি না আমার জানা নেই। কামরুল একজন ভালো ডাক্তার। কিন্তু তার চেয়েও বড়গুণ সে একজন ভালো মানুষ। পৃথিবীতে যত যা ভালো আছে, তার সবকিছুই কামরুলের মধ্যে আছে। তার জন্য দোয়া করি স্রষ্টা যেন তাকে আরও অনেক দিন সচল রাখেন, সক্রিয় রাখেন। এখনকার মতোই যেন সে মানুষের সেবা করতে পারে, মানুষকে সুস্থ রাখতে পারে।’
ডা. মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘ডা. কামরুল এমন একজন মানুষ, যার প্রশংসা না করে বক্তৃতা দেওয়া কঠিন। কারণ পরিচয় হওয়ার পর তার যেসব কর্মকাণ্ড আমি দেখেছি, একজন মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষের যেসব গুণ থাকা দরকার, সবগুলোই তার মধ্যে রয়েছে। আমি মনে করি, রোগীর প্রতি প্রত্যেক চিকিৎসকের মধ্যে কামরুলের মতো আচরণ থাকা দরকার।’
স্মৃতিচারণ করে অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘ডা. কামরুল ছাত্রজীবনে আমার খুব কাছের বন্ধু ছিল না। সে আমাকে চিনতো কি না আমার সন্দেহ আছে। সে বন্ধু হয়েছে এমবিবিএস পাস করার পরে। কারণ আমরা কামরুলকে পড়াশোনা আর স্মিত হাসি ছাড়া কখনই দেখিনি। বন্ধু হওয়ার জন্য যে আড্ডা দিতে হয়, সেটি কখনই সে দেয়নি। কারণ আমরা যখন আড্ডা দিতাম, তখন সে পড়াশোনা নিয়েই থাকতো।’
মজার ছলে তিনি আরও বলেন, ‘খালাম্মা (ডা. কামরুলের মা) হয়তো তাকে বলে দিয়েছিল মেয়েদের সাথে বেশি মিশবা না। পাস করার পর যখন কামরুল আমাদের সাথে একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করল, আমরা খুবই অবাক হতাম এবং একজন আরেকজনকে বলতাম- কামরুল এখন গল্প করে। ছাত্রজীবনে আমরা রাজনীতি করেছি, অনেক মজা করেছি। অনেক কিছুই করেছি পড়াশোনা বাদ দিয়ে। কিন্তু কামরুল বাকি কোনো কিছুই করেনি, শুধু পড়াশোনা করেছে।’
উল্লেখ্য, নামমাত্র খরচে অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠিত শ্যামলী সিকেডি হাসপাতালে কিডনি রোগের চিকিৎসা করা হয়। রোগী ও ডোনার, দুটো অপারেশনই করেন অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। এর জন্য ব্যক্তিগতভাবে একটি টাকাও নেন না তিনি। সিকেডি হাসপাতালের তথ্যে, অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম এ পর্যন্ত ১ হাজার ৪৫টি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন।
কামরুল ইসলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে-৪০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। ১৯৮২ সালে তখনকার ৮টি মেডিকেল কলেজের সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। উচ্চশিক্ষাগ্রহণ করেন রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস অব এডিনবার্গ থেকে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাবা আমিনুল ইসলাম পাকশী ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করায় স্থানীয় রাজাকার ও বিহারীরা তাকে হত্যা করে।
শহীদপুত্র অধ্যাপক কামরুল ১৯৯৩ সালে স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেন। তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। প্রথমবারের মতো সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ করেন ২০০৭ সালে। ২০১১ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে প্রতিষ্ঠা করেন সিকেডি হাসপাতাল। তিনি ৩ কন্যাসন্তানের জনক।