গর্ভপাতে কোয়াকের কাণ্ড, রুদ্ধশ্বাস অস্ত্রোপচারে বাঁচল মা

ডক্টর টিভি রিপোর্ট
2021-09-16 14:58:53
গর্ভপাতে কোয়াকের কাণ্ড, রুদ্ধশ্বাস অস্ত্রোপচারে বাঁচল মা

ছয় ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস যুদ্ধের পর ধীরে ধীরে স্ট্যাবল হলো রোগী

পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা গিয়েছিলেন হাঁতুড়ে চিকিৎসকের (কোয়াক) কাছে। এরপর গর্ভপাতের জন্য তিনি যা করেছেন, তাতে ওই নারীর ইন্টারনাল ব্লিডিং শুরু হয়। মুমুর্ষু অবস্থায় রাতে রোগীকে আনা হয় বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে।

অবস্থা দেখে গর্ভবতীর বাঁচার আশা এক প্রকার ছেড়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করে হাল ছাড়েননি। এরই ফলাফলে ছয় ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অস্ত্রোপচারে বেঁচে গেছে মায়ের প্রাণ। অস্ত্রোপচার দলের সদস্য চিকিৎসক স্যায়েম চৌধুরী নিজের ফেসবুকে এ ঘটনার আদ্যপান্ত তুলে ধরেছেন—

রাখে আল্লাহ! মারে কে— কথাটির মর্ম গতকাল রাতে (১৪ সেপ্টেম্বর) আবার বুঝতে পারলাম নতুন করে। আমাদের গাইনি ইউনিট-১- এ এক রোগী আসল ৫ মাসের গর্ভবতী, রক্ত ও পানি ভাঙা নিয়ে। রোগীর স্বজনরা শুরুতে এর বাইরে কোনো কিছু জানাননি। আমরা আমাদের মতো থ্রেটেন্ড অ্যাবরশন (ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাত) চিন্তা করে ট্রিটমেন্ট চালু করি। পরের দিকে দেখি পেশেন্ট শকে যাচ্ছে! তার মানে কোথাও ইন্টারনাল ব্লিডিং হচ্ছে! USG রিপোর্ট আসলে দেখি IUD সাথে রাপচার্ড ইউটেরাস! রোগীর স্বজনকে আবার জিজ্ঞাসা করলে জানা গেল নতুন কাহিনী।

স্বজনদের ভাষ্যমতে, তারা কোনো এক কোয়াকের কাছে ৫ মাসের বাচ্চা নষ্ট করতে গিয়েছিলেন। কোয়াক কী একটা জিনিস ঢুকালো এবং তারপর থেকে রোগীর এ অবস্থা। ব্লিডিং কন্ট্রোল করতে না পেরে রোগীকে তারা হাসপাতালে নিয়ে আসলেন।

রাত তখন ১০ টা। বুঝতে পারলাম যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে, রাপচার্ড ইউটেরাস! তা না হলে রোগী বাঁচবে না। কিন্তু ভেতরের ঘটনা ছিল আরও ভয়াবহ। অ্যানি আপু অর্ডার দিয়ে ওটি রেডি কর। ব্লাড ডিমান্ড দাও। এনেসথেসিয়া তে দেখি ইকবাল স্যার। সাথে সাথে ছুটে আসলো আরবী আপু, সিফাতি আপু এবং ইউনিট-২ থেকে সুরভী আপু। আমরা উভয় ইউনিটের চিকিৎসকরা তখন এক সাথে, এক টেবিলে।

ওপেন করার পর দেখা গেল, শুধু রক্ত, রক্ত আর রক্ত। ইন্টারনাল ইলিয়াক আর্টারির ব্রাঞ্চগুলো সব লেসেরেটেড। এ রকম কেমনে হলো? পরে বোঝা গেল, ওই কোয়াক যখন বাচ্চা নষ্ট করার জন্য ডিঅ্যান্ডসি করেছিল, তখন কিউরেট, ইউটেরাস ফুটো করে, ভেতরে ঢুকে গিয়ে এই বাজে অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। এতগুলো ব্রাঞ্চ ছেড়া এবং প্রচুর রক্তপাতের কারণে কিছু ঠিক মতো দেখাই যাচ্ছে না। কোনো মতেই রিপেয়ার করা সম্ভব হচ্ছে না। ছুটে এসে ওটিতে উপস্থিত হলেন নফসি আপু। এদিকে প্রচুর রক্তপাতে রোগী পুরো ঝুঁকিপূর্ণ। বিপি পাওয়া যাচ্ছে না, পালস ২০০। ব্লাড পাওয়া যাচ্ছে না।

সন্ধানীতে ব্লাড দিল আমাদেরই দুজন জুনিয়র। একে একে ১৪ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হলো। সর্বমোট ৫টা চ্যানেল ওপেন করা হলো শরীরে। যখন রোগীর এ রকম যায় যায় অবস্থা, তখন সবাই হতাশ হয়ে পড়ল। ইকবাল স্যার তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এবার ছুটে আসলেন মাহবুব স্যার। এসে বললেন, আল্লাহ ভরসা! হাল ছাড়ব না। যতক্ষণ পর্যন্ত মনিটর বিপ বিপ শব্দ করছে, তার মানে রোগী বেঁচে আছে এবং রোগী যুদ্ধ করছে। সুতরাং আমরাও আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করব। বিপি মেশিন খুলে নেওয়া হলো। আমরা সার্জনরা মনিটরের দিকে আর নজর দিব না। এনেসথেসিয়া স্যারেরা সব দেখছেন।

ওদিকে রক্তপাত তখনো বন্ধ হয়নি। এ ধরনের রক্তপাত বন্ধ করার জন্য ভাস্কুলার সার্জন দরকার। বগুড়াতে তো ভাস্কুলার সার্জন নেই। সার্জন সিদ্ধান্ত নিলেন আরও ওপেন করবেন। ইন্টারনাল ইলিয়াক আর্টারি রিপেয়ার করবেন। কিন্তু সেটাতেও ব্যর্থ হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, এখন যদি কিছু না করা হয় রোগী এমনিতেও মরবে। উনি রোগীকে আরও ওপেন করে কমন ইলিয়াক আর্টারি রিপেয়ারের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং সফল হলেন। ছয় ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস যুদ্ধের পর ধীরে ধীরে স্ট্যাবল হলো রোগী। আবার বিপি ঠিকঠাক হলো। অতঃপর আইসিইউতে পাঠানো হলো তাকে।

Now patient is completely stable conscious, oriented, urine output is satisfactory needs no ventilatory support.

এত বড় ঘটনাটি শুধুমাত্র এজন্য শেয়ার করা, অপারেশন শেষে স্যার বলেছিলেন, যদি এই পুরো অপারেশনের কাহিনী ভিডিও করা যেত, তাহলে সাধারণ মানুষ বুঝতো কত ডেডিকেশন ও ধৈর্যের সাথে চিকিৎসকরা যুদ্ধ করে। ভিডিও তো করা সম্ভব হয়নি কিন্তু আসা করি, এ সংক্ষিপ্ত ঘটনায় একটু হলেও আন্দাজ করা যায় পুরো টিমের কষ্ট এবং পরিশ্রমের কাব্য। আমি আমার শজিমেকের শ্রদ্ধেয় স্যার, ম্যাডাম, সিনিয়র এবং জুনিয়রদের নিয়ে গর্বিত।


আরও দেখুন: