শিশুদের জন্য কতটা ভয়ঙ্কর মেনিনজাইটিস, প্রতিরোধে করণীয় কী?
জ্বরের মতো সাধারণ উপসর্গ থাকায় বিষয়টি শুরুতেই বুঝতে পারেন না অভিভাবকরা
আট বছরের শিশু জান্নাত। কয়েকদিন জ্বরের পর হঠাৎ খিঁচুনি; এরপরই অচেতন হয়ে পড়ে। হাঁটা-চলার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু নিউরোলোজি বিভাগে এমন উপসর্গ নিয়ে প্রতিদিনিই ভর্তি হয় জান্নাতের মতো অনেক শিশু।
জ্বরের মতো সাধারণ কিছু উপসর্গ থাকায় মেনিজাইটিসের বিষয়টি শুরুতেই বুঝতে পারেন না অভিভাবকরা। এই রোগের লক্ষণগুলো শুরুতে তেমন না থাকায় গুরুত্বও দিতে চান না। এতে দ্রুতই জটিল হয় রোগটি।
ঢাকা মেডিকেলের শিশু নিউরোলজি বিভাগের ভর্তি হওয়া শিশু জান্নাতের মা জানান, প্রায় ছয় মাসের মতো জ্বরে ভুগছিল জান্নাত। ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরসহ বিভিন্ন জায়গায় একাধিকবার দেখিয়েছেন। কিন্তু হটাৎ একদিন দেখন জান্নাত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে আর হাঁটতে পারছে না।
বিভাগটিতে ভর্তি হওয়া একাধিক শিশুর মধ্যেই প্রায় একই উপসর্গ দেখা যায়। খিঁচুনি দিয়ে জ্বর এবং অচেতন হয়ে পড়ার প্রবণতাই বেশি।
ঢাকা মেডিকেলের শিশু নিউরোলজি বিভাগের ফেইস-বি রেসিডেন্ট ডা.পপি আক্তার জানান, সাধারণত এক বা দুই দিনের জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি নিয়েই শিশুরা বেশি আসে। তবে কারও দেখা যায় খিঁচুনি বন্ধ হয়ে গেছে আবার কারও খিঁচুনি নিয়েই আসে।
মেনিনজাইটিস আক্রান্তের দেশে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১২ লাখ শিশু আক্রান্ত হয় এই রোগে। সাধারণ জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি নিয়ে বেশিরভাগ শিশু ভর্তি হয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যপক ডা. নাজনীন আক্তার বলেন, ‘আমাদের মস্তিষ্কের বাইরে এক ধরনের কাভারিং থাকে। এই কাভারিংয়ে যদি কোনো ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ হয়, তাহলে সেটিকেই বলা হয় মেনিনজাইটিস। এ ধরনের প্রদাহ ব্রেইনকেই আক্রান্ত করে।’
তাৎক্ষনিক চিকিৎসা না নিলে এটি ব্রেইনে ছড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থাকে বলা হয় ম্যানিনগো এন ক্যাফালাইটিস। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি একটি দূরারোগ্য ব্যাধি হিসেবে দেখা দেয়।
বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১২ লাখ শিশু মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ১০ ভাগ শিশু মারা যায়। যারা জীবিত থাকে তাদের বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা তৈরি হয়। যেমন, সেলিব্রাল পলসি নামে এক ধরনের জটিলতা দেখা দেয়, যার মাধ্যমে বাচ্চারা পরবর্তীতে হাঁটতে চলতে পারে না।
এছাড়া বাচ্চার কানে সমস্যা হয় ফলে কানে শুনতে পারে না। চোখে দেখতে সমস্যা হয়। পড়াশুনায় সমস্যা বা কোনো কিছু মনে রাখতে পারে না। যেটাকে লার্নিং ডিজ্যাবিলিটি বলা হয়। এছাড়া কোনো কারণ ছাড়াই খিঁচুনি হতে পারে যাকে মৃগি বা ইপিলিপসি হতে পারে।
সচেতনতার অভাবেই এই রোগীদের সঠিক চিকিৎসা হয় না বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে প্রাণ হারায় প্রায় ১০ শতাংশ। চিকিৎসায় সুস্থ হলেও শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা থাকে।
তবে রোগের প্রাথমিক লক্ষণ চিহ্নিত করে দ্রুত চিকিৎসা দিতে পারলে এ রোগের রাশ টেনে ধরা সম্ভব বলে মত চিকিৎসকদের।
লক্ষ্যণগুলো খুবই সাধারণ হওয়ায় অনেক অবিভাবকই বিষয়টি এড়িযে যান। এ ব্যাপারে নাজনীন আক্তার বলেন, বিভিন্ন ভাইরাসের মাধ্যমে এই সংক্রমণ হতে পারে - ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, অ্যাডিনো ভাইরাস, কক্সাকি ভাইরাস, মিজেজ ভাইরাস, মাউস ভাইরাস এগুলো।
ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে যখনই কোনো ভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ দেখা দেবে, তখনই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। খুব বেশি দেরে হলে শিশু মৃত্যু এবং শারীরিক জটিলতা বেশি হতে পারে।
এ রোগের উপসর্গ সম্পর্কে তিনি বলেন, এর লক্ষণগুলো হচ্ছে বাচ্চা হঠাৎ করে খুব বেশি কান্নাকাটি করবে। বাচ্চা কোনো কিছু খেতে চাইবে না। অনেক বেশি বমি করতে থাকবে। অনেক সময় এই উপসর্গে বাচ্চার খিঁচুনি আসেতে পারে। অথবা খিঁচুনি ছাড়াই বাচ্চা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এই সব লক্ষণ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হবে।
তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা দিলে এই রোগের হাতা থেকে শিশুদেরকে বাঁচানো সম্ভব হয়।
এই রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে ডা. নাজনীন আক্তার বলেন, ব্যাকটেরিয়ার বিপরীতে কিছু টিকা আছে সেগুলো দিয়ে প্রতিরোধ করা যেতে পারে। সাধারণত ৬ সপ্তাহ পর থেকে দেওয়া হয়ে থাকে। সবচেয়ে ক্ষতিকর হচ্ছে ম্যানিনগো কক্কাল মেনিনজাইটিস, হিমোফাইলাস ইনফ্লয়েনজা মেনিনজাইটিস। এই রোগের ভ্যাকসিন সরকার বিনামূল্যে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, এসব লক্ষণ দেখা দিলে বাচ্চাকে অতি দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তাহলেই এই মেনিজাইটিস রোগ প্রতিরোধ করতে পারবো। এছাড়া সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলতে হবে।