বিচ্ছিন্ন হাত জোড়া লাগিয়ে সিলেটের পাঁচ চিকিৎসকের বিরল নজির

হুমায়ুন কবীর হিমু
2021-07-15 22:05:03
বিচ্ছিন্ন হাত জোড়া লাগিয়ে সিলেটের পাঁচ চিকিৎসকের বিরল নজির

অপরাশেন রাত ৮টা থেকে শুরু করে শেষ হয় ভোর সাড়ে ৫টা-৬টায়। সময় লাগে প্রায় ৯ ঘণ্টা।

সিলেটের দেলোয়ার। বয়স ২০ কোঠায়। প্রতিপক্ষের হামলায় ডান হাতের কব্জি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। ফিনকি দিয়ে বের হচ্ছে রক্ত। পরিবারের সবাই দিশেহারা। এত অল্প বয়সে হাত হারিয়ে কীভাবে বাকি জীবন কাটাবেন এ নিয়ে দুশ্চিন্তা। প্রচুর রক্ত ঝরায় নিস্তেজ হয়ে পড়েন দেলোয়ার। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না তার পরিবার।

সিদ্ধান্ত হলো ঢাকায় নেওয়া হবে দেলোয়ারকে। কিন্তু শাটডাউনের কারণে ঢাকায় এনে চিকিৎসক পাবেন কিনা তা নিয়েও চলে আলোচনা। ঢাকার কয়েক জায়গায় খোঁজ নিয়েও ভরসা মিলল না। এভাবে কেটে গেল বেশ কয়েক ঘণ্টা।

একজনের কাছে খবর পেল সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের (সিওমেক) বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা. আব্দুল মান্নান এর আগেও নাকি বিচ্ছিন্ন হাত জোড়া লাগিয়েছেন।

কিন্তু শুক্রবার হওয়ায় এই চিকিৎসককে পাওয়া কষ্টকর। তিনি এদিন সিলেট থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে বড়লেখায় নিজ বাড়িতে রোগী দেখতে যান। রোগীর লোকজন সিলেটের বেসরকারি হাসপাতাল মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে যোগাযোগ করেন বিকেলে।

হাসপাতাল থেকে যোগাযোগ করা হয় ডা. আব্দুল মান্নানের সঙ্গে। প্রথমে তিনি রোগীকে ঢাকায় নিতে বলেন। কারণ, এত সময় পর অপারেশন করলে উন্নতি হবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। রোগীর লোকজন তাকে দিয়েই অপারেশন করাবেন জানালে তিনি দেরি না করে দ্রুত রওনা হন।

সিলেটে আসতে সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। বাসায় না গিয়ে সরাসরি হাসপাতালে আসেন তিনি। পথে থাকতেই নিজের টিমের অন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের হাসপাতালে আনেন তিনি। হাসপাতালে এসেই বিচ্ছিন্ন হাত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন তিনি।

এ ব্যাপারে ডা. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমি এসেই আগে হাত পরীক্ষা করি। কিন্তু হাতটা রোগীর লোকেরা স্যালাইনের মধ্যে ভিজিয়ে রেখেছেন। এতে করে আমি বিপদে পড়ে যাই। কারণ বিচ্ছিন্ন হাত সাধারণত প্লাস্টিকের প্যাকেটে রেখে অন্য প্যাকেটে বরফ দিয়ে রেখে দিতে হয়। এতে করে অপারেশনের পর ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। তারপরও আমার কাছে মনে হয়েছে অপারেশন করলে ভালো ফলাফল হতে পারে। রোগীর লোকদের সঙ্গে কথা বলে অপারেশন শুরু করি।’

তিনি বলেন, এ ধরনের অপারেশন বেশ জটিল ও সময় সাপেক্ষ। ধাপে ধাপে এ অপারেশন করতে হয়। প্রথমে কাটা হাতের দুপাশের অংশ পরিষ্কার করা হয়। থেতলে যাওয়া অংশ কেটে মসৃণ করতে হয়। এরপর প্রথমে কেটে যাওয়া হাড় জোড়া লাগাতে হয়। প্লেট স্ক্রু দিয়ে কাজটি করেন টিমের হাড় বিশেষজ্ঞ (অর্থপেডিক সার্জন)।

এরপর মূল কাজ শুরু করেন ডা. মান্নান। তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমি রক্তনালী জোড়া লাগাই। রক্তনালী জোড়া লাগানোর কারণে বিছিন্ন হাতে রক্ত চলাচল শুরু হয়। রক্ত চলাচল শুরু হলে আমরা কিছুটা আশাবাদী হই। এর পর শুরু হয় স্নায়ু জোড়া দেওয়ার কাজ। কাটা স্নায়ুগুলোকে মুখোমুখি জোড়া দেই আমরা। এটা করি, কারণ হাতের বোধ ঠিক রাখার জন্য।’

অভিজ্ঞ এই সার্জন বলেন, ‘এ কাজ শেষ হলে আমরা মাংস পেশি, টেনডন বা রগ জোড়া লাগানো শুরু করি। কারণ এগুলো হাতের নড়াচড়া করতে কাজ করে। বেশ জটিল ধাপ। একাজেই সময় লাগে বেশি। প্রত্যেকটা টেনডন আলাদা আলাদা করে ঠিক করতে সময় লাগে প্রচুর। এভাবে কাজ করতে সময় লাগে অনেক। সেই রাত ৮টা থেকে শুরু করে কাজ শেষ হয় ভোর সাড়ে ৫টা-৬টায়। সময় লাগে প্রায় ৯ ঘণ্টা। একে একে শেষ হয় শ্বাসরুদ্ধকর ৯ ঘণ্টা।’

ডা. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘প্রায় ৯ ঘণ্টা অপারেশন করে বাসায় গিয়ে উত্তেজনায় ঘুমতে পারিনি। এর আগে আমি আঙুল প্রতিস্থপান করেছি। ২০১৯ সালে একই রকম বিচ্ছিন্ন হাত জোড়া লাগিয়েছি। কিন্তু এবার কাজটি ছিল ভিন্ন রকম। কারণ, এবার হাত বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে অপারেশনের সময় ছিল বেশি।’

অপারেশন সফল হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অপারেশনের পর রোগীর আঙুলে পালস অক্সিমিটার লাগিয়ে দেখেছি রক্তনালী ঠিকমত কাজ করছে। রক্ত চলাচল করছে। রোগী হাত নড়াচড়া করতে পারছেন। রোগীর হাতে বোধও ঠিক আছে।’

‘আমরা আশা করছি, রোগী খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হয়ে যাবেন। রোগীর সুস্থ হতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। তাকে কিছু পুর্নবাসনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে’ যোগ করেন তিনি।

অপারেশন টিমের অন্য সদস্যরা হলেন- সিওমেকের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. মো. মাসুদ হোসেন, অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ ডা. মো. তওফিক আলম সিদ্দীকী, অ্যানেস্থেসিয়া ডা. এন এ শোভন ও ডা. পল্লব।

হাত জোড়া লেগেছে দেখে অভিভূত দেলোয়ার বলেন, ‘হাত কেটে যাওয়ার পর কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার এই হাত আর জোড়া লাগবে। পরিবারের অন্য সবাইও একই দুশ্চিন্তায় ছিল। এখন হাত নাড়াতে পেরে যে অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’


আরও দেখুন: