উপমহাদেশের কিংবদন্তি সার্জন অধ্যাপক ডা. মাজহারুল ইসলাম আর নেই

ডক্টর টিভি রিপোর্ট:
2020-10-11 03:05:53
উপমহাদেশের কিংবদন্তি সার্জন অধ্যাপক ডা. মাজহারুল ইসলাম আর নেই

উপমহাদেশের অন্যতম সার্জন এবং ভাষা সৈনিক অধ্যাপক ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলাম। ফাইল ছবি

মহামারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন উপমহাদেশের অন্যতম কিংবদন্তি সার্জন এবং ভাষা সৈনিক অধ্যাপক ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলাম। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

রবিবার (১১ অক্টোবর) সকাল সোয়া ৯টায় ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলাম রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন।

জানা যায়, গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রবীণ এই চিকিৎসক ও ভাষা সংগ্রামী বারডেমে আইসিইউতে ভর্তি হন। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বারডেম হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অনারারি চিফ কনসালটেন্ট ছিলেন।

তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে এমবিবিএস পাস করেন। প্রখ্যাত এই চিকিৎসক ১৯৮৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে একুশে পদক লাভ করেন।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, রবিবার (১১ অক্টোবর) বাদ যোহর বারডেম জেনারেল হাসপাতালে তার জানাজা হবে। এরপর তাকে রাজধানীর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।

অধ্যাপক ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলাম ১৯৪৪ সালে কল্লা করোনেশন ইংলিশ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৪৬ সালে রিপন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে এম.বি.বি.এস. পাশ করেন। পরে তিনি যুক্তরাজ্য থেকে এফ.আর.সি.এস. যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফ.আই.সি.এস. এবং বি.সি.পি.এস. হতে সার্জারী বিভাগে এফ.সি.পি.এস. ডিগ্রি অর্জন করেন। অধ্যাপক ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলাম শুধু ছাত্র হিসেবেই মেধাবী নন, খেলাধুলা-গানবাজনা-অভিনয় ও লেখালেখিতেও তিনি সমান পারদর্শী। কোনো কিছুই মির্জা মাজহারুলের পথকে থামাতে পারেনি। তিনি জ্ঞানের শক্তি দিয়ে অদম্য সাহস দিয়ে আরাধ্য অর্ঘ্য জ্বালিয়ে জীবনের লক্ষ্য পথে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি এগিয়ে গেছেন আপন আলোয়, এগিয়ে দিয়েছেন শল্য চিকিৎসাকে। তিনি বাংলাদেশের ত্রিকালদর্শী ক্লান্তিহীন পরিব্রাজক।

অধ্যাপক ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলাম এম.বি.বি.এস. পাশ করে অবৈতনিক শল্যচিকিৎসক সার্জন হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন।

পরবর্তীতে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল সদর হাসপাতাল, ফরিদপুর সদর হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এবং সার্জারী বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে সরকারী চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি দেশের খ্যাতনামা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বারডেম জেনারেল হাসপাতালে অবৈতনিক মহাপরিচালক হিসেবে গুরু দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বর্তমানে উক্ত হাসপাতালে সার্জারী বিভাগের মূখ্য উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

অধ্যাপক ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলাম স্কুলে অধ্যয়ন কালে ভারত ছাড় আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন। কলেজে অধ্যয়ন কালে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। কলকাতাতেই তিনি বঙ্গবন্ধুসহ বিশিষ্ট নেতাদের সান্নিধ্য লাভ করেন। জনগনের কল্যাণ কামনা আর দেশপ্রেমই তার রাজনীতির দর্শণ। তিনি আজীবন দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে থেকে কল্যাণধর্মী ও আদশির্ক রাজনীতি চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয় - এই নীতিতে তিনি বিশ্বাসী।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরপরই বাংলা ভাষার ওপর আঘাত আসে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র হিসেবে ভাষা আন্দোলনের একেবারে সূচনা থেকেই তিনি এ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৪৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর গঠিত প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য। ভাষা আন্দোলনের প্রায় প্রতিটি সভা সমাবেশ ও বিক্ষোভে তিনি অংশ নেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভাষা আন্দোলন সংগঠনে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন। একুশের রক্তাক্ত ঘটনার তিনি প্রত্যক্ষ সাক্ষী। ঐতিহাসিক আমতলা সভায় অংশগ্রহন করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা, কন্ট্রোল রুমে দায়িত্ব পালন করা, ভাষা শহীদ বরকতের অপারশনে সহযোগী হিসেবে অংশ নেয়াসহ ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি পর্বে তার উপস্থিতি ছিল প্রনিধানযোগ্য। একুশের পরবর্তী সময়েও তিনি একুশের চেতনা বাস্তবায়ন এবং একুশের স্মৃতি সংরক্ষনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরই উদ্যোগে ও পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে ভাষা আন্দোলন যাদুঘর ও ভাষা আন্দোলন পরিষদ।

মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে কর্মরত ছিলেন। একজন কর্তব্যপরায়ন চিকিৎসক হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়েছেন আপন মমতায়। এছাড়াও তিনি ময়মনসিংহ শহরে মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

একজন শল্য চিকিৎসক হিসেবে অধ্যাপক ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলাম সাফল্যের সোনালী সোপানে অধিষ্ঠিত। তিনি বাংলাদেশে ২০,০০০ জন পেপটিক আলসারে আক্রান্ত রোগীর অস্ত্রোপচার করেছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত লক্ষাধিক রোগীর সফল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেন। বাংলাদেশের চিকিৎসা শিক্ষার উন্নয়ন ও বিকাশে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরনীয়।

একজন সমাজসেবক হিসেবেও তিনি স্বনামধন্য। মানব সেবার প্রতি অদম্য আগ্রহ তার আজন্ম সাধনা। তাঁর নিজস্ব অর্থায়নে ও উদ্যোগে চারান গ্রামে স্বাক্ষরতা অভিযান এবং নিরক্ষরতা দূরীকরন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তাঁর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় চারান গ্রামে স্বাস্থ্যসেবা স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা করা হয়েছে। চারান গ্রামে সম্পূর্ন নিজস্ব অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা করেছেন চারান উচ্চ বিদ্যালয়। নিজ এলাকা তথা, সমগ্র দেশের শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

অধ্যাপক ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলাম ব্যক্তি জীবনে ছিলেন একজন মুক্তমনা উদার সজ্জন বিনয়ী মানুষ।  আপন আলোয় জ্বলছেন তিনি।  আলোক সম্পাত করছেন মানবদেহে, মানবভূমে। হিংসার বদলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরী, মিথ্যার বদলে সত্যের পতাকা উড়ানো, পশ্চাৎপদতার বিপরীতে প্রগতির মশাল জ্বালানো এবং শান্তির পক্ষে কঠিন ইস্পাত তিনি।


আরও দেখুন: