সাইকোবায়োটিকস ও ডিপ কিসেই কি রোগ মুক্তি?
(১)
বিজ্ঞানের একটি তুলনামূলক নতুন শাখা "সাইকোবায়োটিকস"- আমাদের শরীরে বসবাসরত ব্যাক্টেরিয়া কিভাবে আমাদের মস্তিষ্ককে, ভাবনা, অনুভূতি, চিন্তা শক্তি, ব্যক্তিত্ত্বি এবং আমাদের সৃজনশীলতাকে নিয়ন্ত্রণ করে- তা গবেষণা হয় এই শাখায়। আমাদের শরীরের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয় "প্রোবায়োটিক" আর এই উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে আমাদের শরীরে বাস করতে সহযোগিতা করে "প্রিবায়োটিক"। এখন মনে করা হয় যে আমাদের অন্ত্রে (গাট বা কোলন) যে ব্যাকটেরিয়া থাকে, তারা আমাদের মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে, এবং এই নিয়ন্ত্রণ অক্ষ কে "গাট-ব্রেন অক্ষ" বলে।
(২)
আমাদের শরীরে বিভিন্ন জায়গায় ব্যাকটেরিয়া বাস করে, বেশিভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের শরীরের প্রয়োজনেই। প্রশ্ন হলো, এই ব্যাকটেরিয়া আসে কোথা থেকে? প্রথম আসে জন্মের সময়, মায়ের বার্থ ক্যানাল থেকে। এরপর আস্তে আস্তে খাবারের মাধ্যমে এবং বাহ্যিক পরিবেশ থেকে। প্রায় তিন বছর বয়সে একটি বাচ্চার অন্ত্রে প্রাপ্তবয়স্কের সমান ব্যাকটেরিয়া বসবাস করা শুরু করে। একজন মানুষের অন্ত্রে প্রায় এক হাজার প্রজাতির, মোট দশ লক্ষ কোটি (১০০,০০০,০০০,০০০,০০০) ব্যাকটেরিয়া বাস করে। এদেরকে একসঙ্গে আমরা বলি "গাট মাইক্রোবায়োম"। আমাদের এই মাইক্রোবায়োম অনেকাংশেই নির্ধারণ করে আমাদের ইনেট ইম্যুনিটি, এলার্জি এবং অনেক রকম অটোইমিউন ডিজিজ। এছাড়া আমাদের ব্যক্তিত্ব, চেতনা, প্রতীতি, সৃজনশীলতা, ভাবনা, অনুভূতি এবং মনস্তাত্বিকতা। প্রতিদিন এই ব্যাকটেরিয়া পরিবর্তিত হয় আমাদের খাবার, ঔষধের, অসুখ-বিসুখ এবং পরিবেশের কারণে।
(৩)
কিভাবে গাট মাইক্রোবায়োম আমাদের মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে? সাইকোবায়োটিকস এর শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া কি? আমাদের অন্ত্রে যে ব্যাকটেরিয়া থাকে তার বেশিরভাগই মূলত এনেরোবিক এবং বহুলাংশে গ্রাম পজিটিভ। এদের শরীরে লাইপোপলিস্যাকারাইড নেই, যেটি আমাদের ইম্যুন সিস্টেমকে (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) উত্তেজিত করে, প্রো-ইনফ্লামেটরি সাইটোকাইন (ইন্টারলিউকিন, টিউমর নেক্রোসিস ফ্যাক্টর) তৈরি করে। গ্রাম পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া এটি করে না। তারা মূলত আমা্দের শরীরে ইমিউন মডুলেট করে। আমাদের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ল্যাকটোব্যাসিলাস এবং বিফিডোব্যাকটেরিয়া অত্যন্ত উপকারী হিসেবে পরিচিত। এরা আমাদের শরীরে ইনফ্লামেশন দমন করে, তার প্রমান পাওয়া যায় শরীরের রক্তে কম কর্টিসল এর উপস্থিতি দেখে এবং ইনফ্লামেটরি সাইটোকাইন এর মাত্রা দেখে। যাদের শরীরে এই ব্যাকটেরিয়ার পরিমান কমে যায়, তাদের শরীরে ইনফ্লামেশন বেশি হয়, সি রিএক্টিভ প্রোটিন বাড়ে, সাইটোকাইন বাড়ে। এই সাইটোকাইন ব্লাড ব্রেইন ব্যারিয়ার দুর্বল করে দিয়ে সাইটোকাইন মস্তিষ্কে প্রবেশ করায় এবং বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসরণ করে যা আমাদের ব্যবহার, প্রতীতি, মননশীলতা, মেজাজ, ভালোলাগা-খারাপলাগা নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া এরা ভ্যাগাস নার্ভের উপর-ও নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি করে আমাদের মন কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
(৪)
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে একদল বিষণ্ণ মানুষকে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করে, আরেকদল বিষণ্ণ মানুষের শরীরে শুধু উপকারী ব্যাকটেরিয়া দিয়ে চিকিৎসা করে দীর্ঘমেয়াদে একই রকম অবসাদ মুক্তি হয়েছে। যাদের শরীরে এই ভালো ব্যাকটেরিয়া থাকে তাদের মস্তিষ্কের কার্যক্রম পরীক্ষার জন্য ফাংশনাল এমআরআই করে দেখা গেছে যে তাদের মস্তিস্ক দুঃখজনক সংবাদে তেমন সাড়া দেয় না। জীবনে তাদের অবসাদগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা কম থাকে। তাদের শরীরে সেরোটোনিন, ডোপামিন, এপিনেফ্রিন, কর্টিসল এর পরিমাণে অন্যদের তুলনায় ভিন্ন পরিমানে নিঃসৃত হয়। তাদের দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা, প্রতিকূলতা মোকাবেলা করার ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে বেশি। এই ব্যাকটেরিয়া তাদের শরীরে এন্টি-ডিপ্রেসেন্ট হিসেবে কাজ করে। তাদের আত্মহত্যার প্রবণতা কম। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে মেডিকেল স্টুডেন্ট যারা ভালো ব্যাকটেরিয়া পান করে, তারা মেডিকেলের পরীক্ষার আগে এবং পরে অন্যদের তুলনায় কম স্ট্রেসড থাকে, তাদের শরীরে কম কর্টিসল নিঃসৃত হয়।
(৫)
কোথায় পাবেন এই ভালো ব্যাকটেরিয়া বা প্রোবায়োটিক এবং প্রিবায়োটিক? এগুলো কিনতেই পাওয়া যায়। জন্মের সময় ভ্যাজাইনাল ডেলিভারির বাচ্চার শরীরে এই ব্যাকটেরিয়া বেশি থাকে সিজারিয়ান বাচ্চার চেয়ে। কোনো কোনো গবেষণায় প্রমান হয়েছে (যদিও কিছুটা বিতর্কিত) যে সিজারিয়ান বাচ্চার বিষাদগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা বেশি, প্রতিকূলতা মোকাবেলার ক্ষমতা কম, এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। প্রাপ্তবয়স্ক বিবাহিত মানুষের জন্য "ডিপ কিস" বা লালা বিনিময় করা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। প্রতি দশ সেকেন্ড ডিপ কিস করলে গড়ে আশি কোটি (৮০,০০০,০০০) মুখের ব্যাকটেরিয়া বিনিময় হয়। যারা দিনে কমপক্ষে তার স্বামী/স্ত্রী-র সাথে গড়ে নয় বার দশ সেকেন্ডের অধিক ডিপ কিস করেন, গাট মাইক্রোবায়োম, ভাবনা চিন্তা, দীর্ঘমেয়াদী মানসিকতা প্রায় একই রকম হয়ে যায়। স্বামী-স্ত্রী যারা নিয়মিত ডিপ কিস করেন তাদের ইমিউন রেস্পন্স, ইনফ্লামেটরি রেসপন্স, সাইটোকাইন এবং নিউরোট্রান্সমিটারের মধ্যে অনেক সমতা আছে। জীন ট্রান্সক্রিপশনে "স্পাউজাল ইফেক্ট" বলেও একটি মেকানিজম আছে। যদিও একই পরিবেশে বাস, একই ধরণে খাবার খাওয়া তার ভূমিকাও এখানে রয়েছে। ডিপ কিসিং এর সাথে মনোসুখ এর সমান্তরাল ভূমিকা আছে। মানুষ ছাড়া আরো অন্য কোনো প্রাণী ডিপ কিস প্রাকটিস করে না। কেন তাহলে মানুষ এটা করে? কেন মানুষের মুখ পরিষ্কার রাখতে হয়? কেন মহানবী (সাঃ) বলেছিলেন যে মানুষের খুব কষ্ট না হলে আমি তাদের প্রতি বেলা নামাজের আগে মেছওয়াক করে মুখ পরিষ্কার করতে বলতাম?
(৬)
যদিও ডিপ কিস যৌনতা বা প্রজননের অংশ নয়, তবুও স্বামী-স্ত্রীর শরীরতত্বীয় এবং মানসিক কল্যাণে এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এবং স্বল্প-উপলব্ধ। তবে একাধিক মানুষের সাথে ডিপ কিস করলে বিভিন্ন রকম অসুখ ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। যারা সারা জীবনে ছয়জন বা ততোধিক মানুষের সাথে ডিপ কিস করেছেন, তাদের মুখে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ইনফেশন এবং গলার ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে (ডঃ ম-রা গিলিসন, ২০০৯ এবং ২০১২)- এ কারণে সঙ্গীর সংখ্যা কম হতে হবে। স্বামী-স্ত্রী-র মানসিকতা একই রকম হবার ক্ষেত্রে এই ডিপ কিসিং এবং লালা বিনিময় করা বিজ্ঞানসম্মত। ডিপ কিসিং এর মাধ্যমে ফেরোমোন (এ সম্পর্কে অন্য একদিন বিশদভাবে লিখবো) এরও আদান প্রদান হয়, যা আমাদের প্রজনন এবং প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে বার্তা বহন করে। আচ্ছা, মহানবী (সাঃ) তার স্ত্রী যে গ্লাসে পানি খেতেন, তিনি কখনো কখনো সেই গ্লাসের স্ত্রীর মুখের ছাপ লেগে থাকা জায়গায় মুখ রেখে পানি পান করতেন। এটি কি তিনি "ভালো ব্যাকটেরিয়া ট্রান্সফার" করার জন্য করতেন, যাতে তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর মাইক্রোবায়োম একই হয়, একই মানসিকতার হন দুজনে? তিনি চাইলে এই বিষয়টি গোপন রাখতে পারতেন, কিন্তু তিনি কোনো লজ্জা না করে এটি আমাদের কেন জানিয়ে দিয়েছিলেন দেড় হাজার বছর আগে?
তিনি নিশ্চয়ই এমন কাজ করতেন না, যার পিছনে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।
(৭)
যে ব্যাকটেরিয়া আপনি দেখেন না, সেই কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া বাস করে আপনাদের শরীরে, অন্ত্রে। তারা পৃথিবী গড়েছে আমাদের শরীরে আমাদের অজান্তে। শুধু আমাদের একজনের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যাই সমস্ত পৃথিবীর মানুষের সংখ্যার চেয়ে বেশী। তারা কী করে সেখানে? কী তাদের অভিপ্রায়? কেন তারা ডিপ কিস-এর মাধ্যমে একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীর যায়? কেন ওরাল সেক্স এ যায় না? ভ্যাজিনাল ল্যাকটোব্যাসিলাস কিন্তু গাট ল্যাকটোব্যাসিলাস থেকে ভিন্ন। ওরাল সেক্সের মাধ্যমের ভ্যাজিনাল ল্যাকটোব্যাসিলাস কিন্তু আমাদের অন্ত্রে বাস করতে পারে না পিএইচ (ক্ষারতা-র ভিন্নতার জন্য)। তাহলে ওরাল সেক্স কি বিজ্ঞানসম্মত, ধর্মসম্মত?
(৮)
নিশ্চয়ই আপনারা এখন ডিপ কিস নিয়ে গবেষণা করবেন, ডিপ কিস প্রাকটিস করবেন।
আপনাদের জন্য কয়েকটা প্রশ্ন করে আজ শেষ করি, এগুলো আপনাদের জন্য উপহার, চিন্তার খোরাক!
আচ্ছা, ভ্যাজাইনাল ফ্লোরা-তে ল্যাকটোব্যাসিলাস কেন থাকে? তারা না থাকলে কি হতো?
আচ্ছা, আপনারা কখনো পার্কিনসন্স রোগীর কোলন ক্যান্সার হতে দেখেছেন? না হলে কেন না?
যারা ডিপ কিসিং প্রাকটিস করেন, তাদের গাট মাইক্রোবায়োম কি ক্যান্সার প্রতিরোধী?
না হলে কেন না?
যারা ডিপ কিসিং প্রাকটিস করেন, তাদের গাট মাইক্রোবায়োম কি ক্যান্সার প্রতিরোধী?
সুখী মানুষদের কি ক্যান্সার কম হয়? বিষাদগ্রস্ত মানুষদের ক্যান্সার কি বেশি হয়?
কারা বেশি বিষাদগ্রস্থ মানুষ: যারা স্রষ্টায় বিশ্বাসী, না যারা অবিশ্বাসী?
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
বাংলা অর্থ: আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। [সূরা রুম: ৩০: ২১]
হামীম ইবনে কাওছার, এমডি, পিএইচডি, এফএসিপি ।
মলিকিউলার মাইক্রোবায়োলজিস্ট । ক্যান্সার ইম্যুনো-বায়োলোজিস্ট ।
মেডিসিন স্পেশালিস্ট । হেমাটোলজিস্ট । মেডিক্যাল অনকোলজিস্ট। ক্যানসাস, যুক্তরাষ্ট্র।