এমআরএনএ কী, এটি আবিষ্কারে মানুষের যে উপকার হলো

অনলাইন ডেস্ক
2024-10-12 19:09:00
এমআরএনএ কী, এটি আবিষ্কারে মানুষের যে উপকার হলো

মানুষের জিনোম কোডে অবস্থিত মাইক্রোআরএনএ

মাইক্রোআরএনএ ও পোস্ট-ট্রান্সক্রিপশনাল জিন নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য এ বছর চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পেলেন দুই মার্কিন বিজ্ঞানী ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রুভকুন। নোবেল কমিটি সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এর মধ্য দিয়ে এ বছর জিনের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের একটি মৌলিক নীতির আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দিল তারা। 

 

মার্কিন বিজ্ঞানী ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রুভকুন যে কারণে নোবেল পেলেন সেই মাইক্রোআরএনএ ও পোস্ট-ট্রান্সক্রিপশনাল জিন নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া আসলে কী?


ডায়াবেটিস থেকে শুরু করে ক্যানসার, মানব শরীরের নানা ধরনের রোগের পেছনেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জিন দায়ী। সেই জিনের কাজের নিয়ন্ত্রক হিসেবে জুড়ে রয়েছে এক বা একাধিক মাইক্রোআরএনএ (রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড)। এই ক্ষুদ্র আরএনএ তার নিজস্ব আদানপ্রদান পদ্ধতির মধ্য দিয়ে আমাদের শরীরের কোষ থেকে কোষে সংকেত বয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তার গতিপ্রকৃতি এতদিন বিজ্ঞানীদের সম্পূর্ণ অজানা ছিল।


এত দিন আসলে ঠিক কত দিন? উত্তর জানা যাবে ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রুভকুনের গবেষণার বয়সের দিকে তাকালে। গোলকৃমির কোষ নিয়ে কাজ শুরু করেন তাঁরা ১৯৮০‑এর দশকে। সেই গবেষণার ফল হাতে আসে ১৯৯৩ সালে।

 

এই হিসাবে এমআরএনএ নিয়ে গবেষণা নতুন কিছু নয়। এ নিয়ে আগে জানা‑বোঝা ছিল না, বিষয়টি এমনও নয়। তো এই এমআরএনএ আসলে কী?

 

সেই আলাপে ঢোকার আগে জানা দরকার কোষ আসলে কীভাবে কাজ করে? একটি কোষে কী কী থাকে, তা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী মাত্রই জানে। এ এক দারুণ কাঠামো, যেখানে শক্তির কেন্দ্র হিসেবে থাকে মাইটোকন্ড্রিয়া, থাকে সাইটোপ্লাজম (যা কিনা মূল জলীয় অংশ), থাকে ক্রোমোজমসহ বহু খুদে বস্তু। আসা যাক ক্রোমোজমের কাছে। প্রাণী থেকে প্রাণীতে রয়েছে এই ক্রোমোজমের সংখ্যার ভিন্নতা। মানুষের ক্ষেত্রে যেমন ২৩ জোড়া ক্রোমোজম রয়েছে।


সে যাক। এই ক্রোমোজমগুলোতেই থাকছে জিন, যা প্রাণীর বৈশিষ্ট্য নির্ধারক। একটি প্রাণীর কোষে থাকা জিনগুলো এক রকম। এই জিনগুলো বার্তা পাঠায় ডিএনএর কাছে। ডিএনএ বলে অমুক প্রোটিন তৈরি করো। তো সেই প্রোটিন তৈরি হলো। এই হলো মোটাদাগে বিষয়টা। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে–ডিএনএ তো একই রকম, তাহলে ভিন্ন ভিন্ন কোষ ভিন্ন ভিন্ন কাজ কীভাবে করে? মানে স্নায়ুকোষ এক রকম, পরিপাকতন্ত্রের কোষগুলো আরেক রকম, বাহুতে থাকা কোষগুলো আবার আরেকভাবে কীভাবে কাজ করে? বার্তা তো একই যাচ্ছে, তাহলে সেই বার্তার ফল কী করে বদলে যায়?

এই প্রশ্নই ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রুভকুনকে চালিত করেছে গবেষণায়। আর সে গবেষণায় তাঁরা দেখা পেয়েছেন এমআরএনএর। এমআরএনএ আকারে ছোট তাই মাইক্রো‑আরএনএ। আবার এম‑এর আরেক অর্থ কিন্তু ম্যাসেঞ্জারও বটে। অর্থাৎ, জিন থেকে পাওয়া আদেশটি বহনের দায়িত্ব থাকে এই এমআরএনএর কাঁধে। আর এই বার্তাবাহকের ক্যারিশমাতেই বদলে যায় প্রোটিনের ধরন, যা সাইটোপ্লাজমে আকার পায়। আর এই প্রোটিনের ধরন‑ধারণের ওপরই বদলে যায় একেকটি কোষের কাজ।

 

একটু বুঝিয়ে বলা যাক। ধরা যাক, আপনি এমন একটি কারখানা দিলেন, যেখানে বিচিত্র রকমের পণ্য উৎপাদন করা যায়। কারখানার কর্মীরাও সবাই সব ধরনের পণ্য তৈরিতে দক্ষ। এখন আপনি জিনের ভূমিকায়। আপনি বললেন পণ্য উৎপাদন করো। আপনার এই আদেশ প্রধান পরিচলন কর্মকর্তা (পড়ুন ডিএনএ) হয়ে যখন লাইন ম্যানেজারের (এমআরএনএ) কাছে গেল, তখন সেই লাইন ম্যানেজার প্রয়োজনমাফিক পণ্যের লাইনটি চালু করার বার্তা দিল। আর সেই বার্তা মোতাবেক উৎপন্ন হলো পণ্য, অর্থাৎ প্রোটিন।


এই বার্তায় হেরফের হলে কী হতে পারে? উত্তর হচ্ছে ভয়াবহ বিপত্তি ঘটতে পারে। যেমন ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রুভকুন যে কোষ নিয়ে কাজ করেন, সেখানে দেখতে পান দুই ধরনের জিন আছে–লিন‑৪ ও লিন‑১৪। এ দুটি আবার একটি অন্যটির কাজে প্রতিবন্ধক হতে পারে। কীভাবে? লিন‑৪ বিশেষত লিন‑১৪ এর কার্যকারিতাকে বাধা দিতে পারে। কী দিয়ে? উৎপাদিত প্রোটিন দিয়ে। না লিন‑৪ কাজটি সরাসরি করে না। এ কাজটি করে লিন‑৪ এর আদেশ বাস্তবায়নকারী এমআরএনএ। এই লাইন ম্যানেজার এমন এক প্রোটিন তৈরি করে, যা লিন‑১৪‑এর কাজে বাধা দেয়।

সেই শুরু অ্যামব্রোস ও রুভকুন পরে এমন বহু এমআরএনএর সন্ধান পেয়েছেন। শুরুতে অপরাপর বিজ্ঞানীরা এর গুরুত্ব সেভাবে বুঝতে পারেননি। ভেবেছিলেন, এটি তো কোনো এক অণুজীবের কোষে থাকা জিন নিয়ে কথা হচ্ছে। মানুষের কী আসে যায় এতে। কিন্তু যখন এই অণুজীবের কোষেই দেখা মেলে লেট‑৭ জিনের, তখন সবাই নড়েচড়ে বসে। কারণ, এই জিন তো রয়েছে মানুষের শরীরেও।


তখন সবাই মনোযোগ দিতে শুরু করে মাইক্রোআরএনএর দিকে, যা শরীরে জিনের অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি আবিষ্কারের মাধ্যমে বহুকোষী জীবের শরীরে জিনের কার্যক্রম নিয়ে কাজ করা সহজ হবে। আর তাতে করে শরীরের ভেতরে থাকা বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্রম নিয়েও জানা যাবে বিস্তারিত।

 

অ্যামব্রোস ও রুভকুনের গবেষণার ফলাফল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এক দিগন্তের দিশা দিচ্ছিল, যা ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে, এমআরএনএর ক্যারিশমায় একেক অংশের কোষ যেমন একেকভাবে কাজ করে, একেক অংশে যেমন একেক ধরনের কাজে দক্ষ কোষের বিস্তার হয়, ঠিক তেমনি এর একটু হেরফেরে ঘটতে পারে মহাবিপত্তি। যেমন, কোনো এক আদেশে প্রোটিন উৎপাদন করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলল, তো হতে পারে ক্যানসার সৃষ্টিকারী কোষের জন্ম, আবার হতে পারে ডায়াবেটিকের মতো দীর্ঘসূত্রী সংকটও। এমন বহু বিচিত্র সংকটের মধ্য দিয়ে তো মানুষ যায়ই। আছে নানা রোগ‑শোক। ফলে এই রোগ‑শোকের অন্যতম কারণ হিসেবে সেই লাইন ম্যানেজারের (পড়ুন এমআরএনএ) ঔদাসিন্য বা স্বেচ্ছাচারিতাকে দায়ী করা যেতে পারে।


অর্থাৎ, একটা অস্বাভাবিক ব্যবস্থাপনার কারণে আমরা নানা রোগে ভুগতে পারি। এখন এই অনুমানই কিন্তু আবার খুলে দিল নতুন সম্ভাবনার দরজাও। অর্থাৎ, অব্যবস্থাপনাকে, লাইন ম্যানেজারের ঔদাসীন্য বা স্বেচ্ছাচারিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে সুব্যবস্থাপনায় আনতে পারলেই হতে পারে রোগ‑শোকমুক্তি। এমনকি বিশেষ বদল আনা সম্ভব হলে শরীরে প্রভাব বিস্তারকারী জীবাণুকেও আগ্রাসী হওয়া থেকে রোধ করা যেতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই পথ ধরেই কিন্তু ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে করোনাভাইরাসের টিকার দেখা পেয়েছিল মানুষ। খুব বেশি আগের কথা নয়। একটু মনে করার চেষ্টা করলেই দেখবেন মনে পড়ছে ‘মডার্না’, ‘ফাইজার’ ইত্যাদি টিকার নাম।

 

সে যাই হোক, আমাদের দেহে মাংসপেশী থেকে শুরু করে স্নায়ুকোষের মতো নানা ধরনের ব্যতিক্রমী কোষের কার্যাবলী ও তাদের গড়ে ওঠা সরাসরি নির্ভর করে আদতে এই এমআরএনএর ওপর। আর এই জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণকারী এমআরএনএর উপস্থিতি ও ক্রিয়াপদ্ধতি শনাক্তের কারণেই এবার পুরষ্কৃত হলেন ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রুভকুন। তাঁরা বলছেন, ১৯৬০‑এর দশক ও তারপরের বছরগুলোতে কোষের যে অন্দর সম্পর্কে মানুষ জানত, তার থেকে একটি কোষ এবং অতি অবশ্যই তার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা জিন, ডিএনএ ইত্যাদি আলাদাভাবে কাজ করে। চেনা আরএনএর চেয়ে ক্ষুদ্র আকারের এক ধরনের আরএনএ আছে, যা একই সাথে বার্তাবাহকের কাজ করে এবং জিন থেকে আসা আদেশ‑নিষেধের ম্যানিপুলেটর হিসেবে কাজ করে।


এর পর বহু জল গড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা এখন জানাচ্ছেন, মানুষের জিনোম কোডে মাইক্রোআরএনএ রয়েছে এক হাজারের মতো। আমাদের দেহের বিভিন্ন কোষ কীভাবে বাড়তে থাকে এবং কাজ করে তা এই মাইক্রোআরএনএ দিয়ে সহজেই জানা যাবে। সেটি জানতে পারলে বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসাও সহজ হবে।


আরও দেখুন: