টিকায় ঠেকানো যাবে বার্ধক্য!

অনলাইন ডেস্ক
2021-12-17 19:45:26
টিকায় ঠেকানো যাবে বার্ধক্য!

বিজ্ঞানীদের ইঁদুরের ওপর চালানো পরীক্ষার ফলাফল গত ১০ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা নেচার এজিং-এ।

বয়সে আর জবুথবু হয়ে পড়তে হবে না? বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে চলা ঠেকাতে পারবে টিকাই। অবিশ্বাস্য মনে হলেও ইঁদুরের ওপর একটি টিকার সফল পরীক্ষা এমন দাবি করেছেন গবেষকরা।

বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, ‘মানুষের ওপর সফল হলে এই টিকা একটি নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। যার জন্য মানুষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সভ্যতা আধুনিক হয়ে ওঠার আগে থেকেই।’

আনন্দবাজার জানায়, আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এজিং (এনআইএ)’ এর বিজ্ঞানীদের ইঁদুরের ওপর চালানো পরীক্ষার ফলাফল গত ১০ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার এজিং’-এ।

গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, পরীক্ষায় সফল টিকাটি ইঁদুরের শরীর থেকে বুড়োটে, অথর্ব হয়ে পড়া কোষগুলোকে সরিয়ে দিতে পেরেছে। তার ফলে, ইঁদুরের আয়ু বেড়েছে। তাদের বার্ধক্যজনিত অনেক রোগ পুরোপুরি সেরেও গেছে।

মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অন দ্য বায়োলজি অব এজিং অ্যান্ড মেটাবলিজমের সহকারী কর্মকর্তা অধ্যাপক পল রবিন্স বলেন, ‘অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য গবেষণা। গবেষকরা যে পথ ধরে এগিয়েছেন, তাতে তাত্ত্বিকভাবে এই টিকার পরীক্ষা মানুষের ওপরেও সফল হওয়া উচিত। তবে মানুষের আগে আরও কয়েকটি স্তন্যপায়ীর ওপর এই পরীক্ষা চালিয়ে দেখা উচিত।’

টিকা বানাতে ইঁদুরের কোন ধরনের কোষগুলোর ওপর নজর রেখেছিলেন গবেষকরা?

এনআইএ জানিয়েছে, সেনেসেন্ট কোষ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অত্যধিক চাপে বা অন্য কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে এই কোষগুলোর স্থিতিস্থাপকতা (‘ইলাস্টিসিটি’) পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। তখন কোষগুলোর আর বিভাজন হয় না। কিন্তু তারা মরেও যায় না।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সেনসেন্ট কোষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দেহে জমতে থাকে দ্রুত। এই কোষগুলোর ‘পাহাড়’ সরানো তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে দেহের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষগুলোর পক্ষে।

জমতে জমতে শুধুই যে পাহাড় হয়ে ওঠে তা-ই নয়। এই সেনেসেন্ট কোষগুলো থেকে এক ধরনের যৌগের ক্ষরণ হয়। যা নানা ধরনের প্রদাহ (‘ইনফ্ল্যামেশন’) সৃষ্টি করে। তার ফলে, সেনেসেন্ট কোষগুলির আশপাশে থাকা সুস্থ সবল কোষগুলোর প্রচুর ক্ষতি হয়।

এর আগে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শরীরে এই সেনেসেন্ট কোষগুলোর বাড়-বাড়ন্তের কারণেই ক্যানসার, অ্যালঝেইমার্স এবং স্ক্লেরোসিসের মতো বার্ধক্যজনিত নানা জটিল রোগের সূত্রপাত হয়। ধমনীতে রক্ত চলাচল থমকে যায় সামনে বাধার দেওয়াল (আর্টারি প্লেক্‌স) তৈরি হয়ে যাওয়ায়। এগুলো সারানো আর সম্ভব হয় না।

সেনেসেন্ট কোষগুলোকে সরানোর জন্য নানা ধরনের ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা গত এক দশক ধরেই চলছে। তাদের কোনো কোনোটি এখন হিউম্যান ট্রায়ালে রয়েছে।

রবিন্স বলেছেন, ‘তবে ওই সব ওষুধের চেয়ে টিকার কার্যকারিতা অনেক বেশি হবে বলেই আশা করছি। কারণ, ওষুধ তো ব্যবহৃত হবে দেহে সেনেসেন্ট কোষ জমতে জমতে পাহাড়ে পরিণত হওয়ার পর। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দেহের সুস্থ কোষগুলোর ততক্ষণে অনেকটাই ক্ষতি হয়ে গেছে। আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষগুলোও।’

‘কিন্তু ৫০ বছর বয়স হলেই যদি এই টিকা দেওয়া সম্ভব হয়, তা হলে শরীরে এই সেনেসেন্ট কোষ গড়েই উঠতে পারবে না। জমতে জমতে পাহাড় হয়ে ওঠা তো অনেক দূরের কথা। টিকা দিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষগুলোকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে যাতে সেনেসেন্ট কোষ তৈরি হচ্ছে দেখলেই তারা তাদের নিকেশ করে দিতে পারে’ যোগ করেন তিনি।

কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। এই সেনেসেন্ট কোষগুলো দেহের সর্বত্রই তৈরি হয়। এক জায়গার সেনেসেন্ট কোষের সঙ্গে দেহের অন্য জায়গার সেনেসেন্ট কোষের আচার-আচরণে মিলও থাকে না।

গবেষকরা একটি বিশেষ ধরনের সেনেসেন্ট কোষের ওপর নজর রেখেছিলেন। যেগুলি তৈরি হয় ধমনী, শিরা ও রক্তজালিকার একেবারে ভিতরের দিকে থাকা এন্ডোথেলিয়াল কোষগুলোতে। এগুলিকে বলা হয় সেনেসেন্ট ভাসক্যুলার এন্ডোথেলিয়াল কোষ।

তার পর তারা খুঁজে বের করেন সেই কোষগুলোর ওপরের স্তরে কোন প্রোটিনটিকে বেশি পরিমাণে দেখা যাচ্ছে। কারণ, গবেষকরা চেয়েছিলেন সেই প্রোটিনটিকেই তাদের বানানো টিকার লক্ষ্যবস্তু করতে।

গবেষকরা তেমন একটি প্রোটিন খুঁজে পান, যার নাম ‘গ্লাইকোপ্রোটিন ননমেটাস্ট্যাটিক মেলানোমা প্রোটিন বি’ (জিপিএনএমবি)। বার্ধক্যজনিত বেশ কয়েকটি জটিল রোগ, মেলানোমাসহ কয়েক ধরনের ক্যানসারের ক্ষেত্রে এই প্রোটিনটিকে বেশি পরিমাণে সেনেসেন্ট কোষে জমতে দেখা যায়।

মানব দেহকোষ নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েও গবেষকরা দেখেছেন, এই প্রোটিনটি স্ক্লেরোসিস রোগীদের সেনেসেন্ট কোষে অনেক বেশি পরিমাণে দেখা যায়। এই প্রোটিনের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্যই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধমনীতে রক্ত সঞ্চালন বাধাপ্রাপ্ত হয়।

পরীক্ষাটি চালানো হয় মধ্য বয়সী ইঁদুরের ওপর, যাতে তাদের বার্ধক্য ও বার্ধক্যজনিত রোগের গতিতে লাগাম পরানো সম্ভব হচ্ছে কিনা বোঝা যায়। দেখা গেছে, টিকা ৯৫ শতাংশ সফল হয়েছে ইঁদুরের ক্ষেত্রে।


আরও দেখুন: