হৃদরোগ সম্পর্কে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
হার্ট অ্যাটাক হলে ১০০ জনের ভেতর ৩০ জনই হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে না (ডা. মারুফ রায়হান খান)
হৃদরোগের ভেতর হার্টের রক্তনালি সরু হয়ে যাওয়া বা চেপে যাওয়া বা এস্কেমিক হার্ট ডিজিজ এবং রক্তনালিতে কোলেস্টেরল জমে যাওয়ার সমস্যা বেশি দেখা যায়। রক্তনালিতে কোলেস্টেরল জমে গেলে ধমনির প্রবাহ ব্যাহত হয়। এতে রক্তনালির ভেতর রক্ত জমাট বেঁধে যেয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়। হার্ট অ্যাটাক হলে ১০০ জনের ভেতর ৩০ জনই হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে না। তার আগেই মারা যায়। আর যারা হাসপাতালে পৌঁছায়, তাদের ভেতর ১০ শতাংশ রোগী যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা না পেলে মৃত্যুবরণ করে। আসুন হৃদরোগ সম্পর্কে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নিই।
১. বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশীয় অঞ্চলের মানুষের প্রথম হার্ট অ্যাটাক হওয়ার বয়স সাধারণত ৫১/৫২ বছর। অথচ ইউরোপ-এমেরিকায় সাধারণত এটি ৬৫ বছরের আশাপাশে গিয়ে হয়।
২. সাধারণ মানুষ তো বটেই হার্টের রোগীরাও ডিম খেতে পারবে। কুসুমসহই খাবে। ডিমের সাদা অংশে থাকে প্রোটিন, কুসুমে থাকে ভালো ফ্যাট। দুটোই স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী ও প্রয়োজনীয়। দিনে ১টি ডিম খাওয়া যেতেই পারে।
হার্টের রোগীরা দুধ খেতে পারবে। দুধ ভালো করে জ্বাল দিয়ে উপরে জমা সরটুকু না খেয়ে শুধু দুধটুকু খাবে।
৩. হার্টের রোগীদের গরু ও খাসির মাংস খাওয়া যাবে। তবে অল্প পরিমাণে খেতে বলা হয়। ২-৩ টুকরো। চর্বির অংশটুকু ফেলে দিয়ে। ঝোল যতোটা সম্ভব কম খেতে হবে। অনেকে বলে থাকে, আমি মাংস খাই না, শুধু মাংসের ঝোল দিয়ে রুটি খাই। এটা বরং আরও ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ ফ্যাটগুলো ঝোলেই জমা হয়।
৪. হার্টের রোগীদের ভয়ঙ্কর শত্রু লবণ। যতোটা সম্ভব কম লবণ খেতে হবে। রান্নায় কম লবণ ব্যবহার করতে হবে। পাতে আলাদা করে লবণ খাবার অভ্যেস পরিহার করতে হবে। যেসব খাবারে অতিরিক্ত লবণ থাকে যেমন : চিপস, ফাস্ট ফুড ইত্যাদির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কাঁচা লবণ, পাকা লবণ, ভাজা লবণ, টালা লবণ--সব লবণই ক্ষতিকর।
চিনিকে বলা হয় হোয়াইট পয়জন। এটি যতো কম খাওয়া যাবে ততোই মঙ্গল। অতিরিক্ত ভাত খাবার প্রবণতা কমাতে হবে। এগুলো ডায়াবেটিস ডেকে আনতে পারে।
৫. সেদিন সিসিউতে রাউন্ডে গিয়ে দেখি ২৫, ২৮ ও ৩০ বছর বয়সী ৩ জন পুরুষ একইদিনে গুরুতর হার্ট এটাক নিয়ে শুয়ে আছে। এমন কম বয়সী হার্ট এটাকের রোগী অহরহই পাওয়া যাচ্ছে। এদের না আছে ডায়াবেটিস, না আছে হাই ব্লাড প্রেশার, না আছে রক্তে অত্যধিক কোলেস্টেরল, না অতিরিক্ত ওজন, না অপরিশ্রমী। তাহলে কেন এমন বড়ো হার্ট এটাক? এর মূল কারণ ধূমপান। ধূমপান যে কী ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনা তা কল্পনাই করা যায় না।
ধূমপান ছাড়ার কোনো বিকল্প নেই। ধূমপান ছাড়ার দুই বছরের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে।
৬. এক সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট হাঁটতে হবে।
-তার মানে হচ্ছে কেউ যদি ৩০ মিনিট করে হাঁটে, তবে সপ্তাহে ৫ দিন হাঁটতে হবে।
-১ দিন পরপর হাঁটলে ৫০ মিনিট করে হাঁটতে হবে।
-একসাথে টানা দুদিন বা ৪৮ ঘণ্টা হাঁটা বন্ধ করে দেওয়া যাবে না।
- একনাগাড়ে কমপক্ষে ১০ মিনিট না হাঁটলে সাধারণত সেটাতে কোনো উপকার হয় না।
একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, হাঁটা শুরু করার সাথে সাথেই খুব জোরে হাঁটা শুরু না করতে বলা হয়ে থাকে। কেউ যদি ৩০ মিনিট হাঁটে, তাহলে প্রথম ৫-৭ মিনিট ওয়ার্ম আপ করে নেবে, তারপরের ১৫-২০ মিনিট জোরে জোরে হাঁটবে, আবার তারপরের ৫-৭ মিনিট ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে নিয়ে আসবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে শরীরকে এডজাস্ট হবার সময় না দিয়ে সাথেসাথেই হাঁটা শুরু করা যাবে না। এতে হার্ট এটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। সকালের চেয়ে বিকেল/সন্ধ্যায় হাঁটাকে অনেক গবেষণা বেশি উপকারী হিসেবে বিবেচনা করে।
৭. রাত তিনটা থেকে সকাল নয়টা--এই সময়টুকুতে হার্ট এটাক ও স্ট্রোক হবার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে।
৮. বুকে তীব্র ব্যথা, কিংবা এমন বুকে চাপ যেন বুকের ওপর একটা পাথর বসে আছে, ব্যথা/চাপ কিছুতেই কমে না, ব্যথা ছড়িয়ে যাচ্ছে চোয়ালে, গলায়, বাহুতে, পিঠে, পেটের উপরিভাগে। প্রচণ্ড ঘাম দিচ্ছে শরীর। খুব বমি বমি ভাব।শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আগে বুকে ব্যথা উঠলে বিশ্রাম নিলে বা জিহবার নিচে স্প্রে দিলে কমে যেতো আজ কিছুতেই কমছে না। মনে হচ্ছে মারাই যাবে। এগুলো সবই হার্ট এটাকের লক্ষণ।
এমন লক্ষণ দেখা দিলে প্রথম কাজটিই হবে, যতো দ্রুত সম্ভব হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে গিয়ে একটি ইসিজি করা। এর-ওর সঙ্গে নানা পরামর্শ করে সময়ক্ষেপণ করা, মনে হচ্ছে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা ঠিক হয়ে যাবে এই ভেবে শুয়ে থাকা, এমনকি চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে গিয়েও সময় নষ্ট করা উচিত না। সরাসরি ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টে।
৯. টাইম ইজ মাসেল। হার্ট অ্যাটাক হবার পর যতো সময় যায়, ততো হার্টের মাংসপেশি নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। যতো তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা যায়, ততোই সফলতার সম্ভাবনা বাড়ে এবং কম্পলিকেশান্সের সম্ভাবনা কমে। দেরি করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে অনেকক্ষেত্রেই ভালো চিকিৎসা অপশনের সুযোগ কমে আসে। যেমন: প্রাইমারি পিসিআই বা থ্রম্বোলাইটিক বারো ঘন্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেলে সাধারণভাবে দেওয়া যায় না। সময়মতো আসতে পারলে সর্বাধুনিক চিকিৎসা হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে ক্যাথ ল্যাবে রোগীকে নিয়ে ব্লক থাকলে রিং স্থাপন করে ফেলা। বাংলাদেশের খুব কম হসপিটালেই এটি সম্ভব। সেক্ষেত্রে থ্রম্বোলাইটিকস-ই প্রধান চিকিৎসা হয়ে ওঠে। টেনেকটিপ্লেজ সেক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে রোগীর সামর্থ্য থাকলে। উন্নত বিশ্বে নানা কারণে স্ট্রেপটোকাইনেজ এখন আর ব্যবহৃত হয় না।
১০. হার্টের রোগ থেকে বাঁচতে ডায়াবেটিস, হাই প্রেশার, ডিজলিপিডেমিয়া (অতিরিক্ত কোলেস্টেরল) ও ওবেসিটির যথাযথ চিকিৎসা করতে হবে।
মহান আল্লাহর কাছে সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
ডা. মারুফ রায়হান খান
হৃদরোগবিদ্যার শিক্ষার্থী