কণ্ঠের যত্নে করনীয়
কণ্ঠের যত্নে করনীয় (ইনসেটে অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু)
বিশ্ব কণ্ঠ দিবস কি ও কেন
প্রতি বছর ১৬ ই এপ্রিল বিশ্বব্যাপী পালিত হয় কণ্ঠ দিবস। ১৯৯৯ সালে ব্রাজিলে প্রথম এবং ২০০২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় কণ্ঠ দিবস। ২০২৪ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় “Resonate, Educate, Celebrate,” কণ্ঠের ব্যবহার, যত্ন, রোগের চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়ানোই এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য।
সুস্থ কণ্ঠের গুরুত্ব
কণ্ঠকে শুধুমাত্র যোগাযোগের প্রধান উপায় ভাবলে ভুল হবে। বাক্যের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে কণ্ঠের ওঠানামা আমাদের ব্যবহার করা শব্দের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনার কথা কি প্রভাব সৃষ্টি করবে তার ৩৮% নির্ভর করে কণ্ঠের ওঠানামার (tone) অপর। আর তাই দৈনন্দিন সাংসারিক বা কর্মক্ষেত্রে কথাবার্তার জন্য ভাল কণ্ঠের গুরুত্ব অনেক বেশি।
পেশাগত কণ্ঠ ব্যবহারকারি মানুষের জন্য কণ্ঠই সবকিছু।পেশাগত কণ্ঠ ব্যবহারকারি বলতে আমরা বুঝি যাদের পেশার জন্য কণ্ঠ প্রধান বা গুরুত্বপূর্ন নিয়ামক যেমনঃ গায়ক, অভিনেতা, শিক্ষক, উকিল, ধারাভাষ্যকার, সেলসম্যান, কলসেন্টারের কর্মী ইত্যাদি।
পরিসংখ্যানে কণ্ঠের সমস্যা
আমেরিকাতে ২৯% মানুষ জীবনে কোন না কোন সময় কণ্ঠের সমস্যায় ভুগে থাকেন এবং এতে যে কর্মক্ষমতা নষ্ট হয় তার অর্থ মূল্য প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। বছরে প্রতি ১৩ জনে ১ জন এই সমস্যায় পড়েন। বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে মহিলা এবং শিশুদের ক্ষেত্রে ছেলেরা এই সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হয়।
আমেরিকাতে পেশাগত কণ্ঠ ব্যবহারকারিদের মাঝে এই বিষয়ে চালানো জরিপ অনুযায়ী শিক্ষকদের ১১% কণ্ঠের সমস্যায় ভুগছেন। শিক্ষক ছাড়া অন্য পেশার জন্য এই হার ৬.২%।
কণ্ঠের সমস্যায় চাকরি হারিয়েছেন এমন সংখ্যা শিক্ষক ২০% এবং অন্য পেশাজীবী ৪%।
অন্যান্য জরিপে দেখা যায় যে ৪৬.০৯% কণ্ঠশিল্পী, ৪৫% কলসেন্টারের কর্মী কণ্ঠের সমস্যার কারনে কর্মক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
কণ্ঠের সমস্যার কারণ কিঃ
১. কণ্ঠনালির প্রদাহ :
এ প্রদাহ দুধরনের। যেমন - তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিস।কণ্ঠনালির ভাইরাসজনিত, আবহাওয়া পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণেও কণ্ঠনালির প্রদাহ হতে পারে। যদি ব্যাকটেরিয়ার কারণে কণ্ঠনালিতে ইনফেকশন ও শ্বাসকষ্ট হয়, তখন চিকিৎসা দরকার। পাকস্থলীর অ্যাসিড রিফলাক্সের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কণ্ঠনালির প্রদাহ হতে পারে। ধূমপান, অতিরিক্ত চা বা পানীয় পান করলে, হাঁপানির জন্য ইনহেলার ব্যবহার বা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিস হতে পারে।
২. কণ্ঠস্বরের অতিব্যবহার :
অতি উচ্চৈস্বরে অতিরিক্ত কথা বলা, দীর্ঘমেয়াদি বা পরিবর্তিত স্বরে কথা বললে কণ্ঠনালির প্রদাহ হতে পারে।
৩. এতে পলিপ, নডিউল বা সিস্ট, রক্তক্ষরণ।
৪. কন্ঠনালীর ক্যান্সারঃ
গলার স্বর পরিবর্তনের ২১ দিনের মধ্যো ভালো না হলে, চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া দরকার। কন্ঠনালীর ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্নয় করে চিকিৎসা করলে সম্পূর্ন ভালো হয়ে যায় এবং এ রোগের সব ধরনের চিকিৎসা যেমন- সার্জারী, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি আমাদের দেশে বিদ্যমান।
কন্ঠের যত্নে কিছু উপদেশঃ
১। সবার আগে দরকার সচেতনতা। অনেকেই জানেনা যে তাদের পেশার জন্য সুস্থ ও সুন্দর কণ্ঠ কতটা জরুরী।
২। নিজের কণ্ঠ নিজে শুনতে হবে, যেন কোন সমস্যা তাড়াতাড়ি আন্দাজ করা যায়।সমস্যা ৩ সপ্তাহের বেশি থাকলে নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
৩। আর্দ্রতা কণ্ঠের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরী, তাই প্রতিদিন অন্তত ২ লিটার পানি পান করতে হবে।
৪। কণ্ঠ ব্যবহারে সাবধানী হোন। অতিউচ্চ বা পরিবর্তিত স্বরে কথা বলবেন না।
৫। এলকোহল, কফি, চা, কোমল পানীয় শরীরের কোষে পানি শূন্যতা ঘটায়। এগুলো অল্প পরিমাণে খেলে সমস্যা নেই, তবে বেশি নয়।
৬। ধূমপান এবং এলকোহল , তামাক, গাজা ও আন্যান্য নেশা সম্পূর্ন পরিহার করুন।
৭। ঘুমাতে যাওয়ার কমপক্ষে ২ ঘন্টা আগে খাওয়া শেষ করুন এবং অল্প আহার করুন।
৮। অতিরিক্ত টেলিফোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
৯। অপ্রয়োজনে বারবার গলা পরিষ্কার/ কাশি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
১০। শুষ্ক আবহাওয়া কণ্ঠের জন্য ক্ষতিকর। শীতাতপ যন্ত্রের বাতাস যাতে জলীয়বাষ্প কম, কণ্ঠের আদ্রতা কমিয়ে দেয়। রাতে আদ্রতাকরণ যন্ত্র ব্যয়ভার করুন।
১১। উড়োজাহাজে বাতাস শুষ্ক থাকে।কফি, চা, কোমল পানীয় এড়িয়ে চলুন। প্রতি ঘণ্টায় কমপক্ষে ৮ আউন্স পানি পান করুন।
১২। গলায় গারগিল করা যেতে পারে ( ১/২ টেবিল চামচ লবণ+ ১/২ টেবিল চামচ বেকিং সোডা+ ৬ আউন্স হাল্কা গরম পানি)।
১৩। অনেক সময় গলা শুকনা থাকলে অথবা মিউকাস জমে থাকলে আমরা জোরে কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করি যা অত্যান্ত ক্ষতিকর।এ জন্য যা করবেন – প্রথমে বুক ভরে শ্বাস নিন , কিছুক্ষণ ধরে রাখুন, এবারে শ্বাস ছাড়ার সময় আস্তে শব্দ করুন।
১৪। এলার্জি বা ঠাণ্ডার সমস্যায় আমরা হরহামেশা এন্টিহিস্টামিন ঔষধ ব্যবহার করি।এন্টিহিস্টামিন ঔষধ কণ্ঠের শুষ্কতার কারন। তাই সম্ভব হলে এগুলো এড়িয়ে স্টেরয়েড স্প্রে নাকে ব্যবহার করুন।
১৫। পেশাগত কণ্ঠ ব্যবহারকারিদের NSAID জাতীয় ব্যাথার ঔষধ এড়িয়ে চলা উচিত।
১৬। যখন বেশি মিউকাস উৎপন্ন হয় তখন মিউকাস তরলকারি ঔষধ ব্যবহার করতে পারেন।
১৭। স্থানীয় চেতনানাশক যথেচ্ছ ব্যবহার করবেন না।
১৮। ধোয়া/ধূলা/দূষিত বাতাস এড়িয়ে চলুন।
১৯। গান গাওয়ার সময় শারীরিক, মানসিক অবসাদ মুক্ত থাকতে হবে। হাল্কা গরম পানিতে গারগিল করতে পারেন।
২০। নিয়মিত ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত ঘুম ।
লেখকঃ
অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু
এমবিবিএস, এমএস, (ই এন টি এন্ড হেড নেক সার্জারি)
অধ্যাপক. নাক কান গলা বিভাগ,
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোড হাসপাতাল, ঢাকা।
সভাপতিঃ বাংলাদেশ ভয়েজ এসোসিয়েশন।
মোবাইলঃ ০১৭১১৬১৭৭৩৫ / ০১৫৫২৩০৬৭৭২
E-Mail: dr_mani1234@yahoo.com