শিশুদের ডিভাইস আসক্তি: কিভাবে প্রতিরোধ করবেন?

ডা. সিফাত ই সাইদ
2023-09-24 16:07:52
শিশুদের ডিভাইস আসক্তি: কিভাবে প্রতিরোধ করবেন?

মোবাইলে আসক্ত শিশু (ইনসেটে ডা. সিফাত ই সাইদ)

অতিরিক্ত স্ক্রিন দেখা শিশুদের বিকাশ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, আমরা সবাই সেটা জানি। কিন্তু এই যুগে ডিভাইস ছাড়া কি একটা শিশুকে বড় করা যায়?
যায় হয়ত, তবে বাস্তবে খুবই কঠিন একটি কাজ।

ধরে নিচ্ছি যে, এই কঠিন কাজটি বেশিরভাগ বাবা-মা এর পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছেনা এবং একটি শিশু কম বেশি স্ক্রিন দেখছে। কিন্তু এই স্ক্রিণ দেখার কারণে তার ক্ষতি হতে পারে, শিশু ডিভাইস আসক্ত হতে পারে, তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

তাই কিভাবে, কতটা স্ক্রিন দেখলে শিশুকে আসক্তি থেকে দূরে রাখা যাবে, সেই বিষয়ে এই লেখাটি আমি পেশায় একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং শিশু মনোরোগবিদ্যা আমার অত্যন্ত আগ্রহের বিষয়। একই সাথে আমি একটি শিশুর মা। এই দুইটি অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে নিচের practical recommendation গুলো দেয়া:

১. শিশুকে স্ক্রিন দিবেন কিন্তু ইন্টারনেট অফ রাখবেন। এই অংশটি অত্যন্ত জরুরি। ইন্টারনেট অন থাকলে শিশু ক্রমাগত স্ক্রল করে এক ভিডিও থেকে অন্য ভিডিওতে চলে যায়, এবং প্রায়ই এমন কিছু কনটেন্ট দেখে ফেলে যা একেবারেই তার বয়স উপযোগী নয়। ক্রমাগত স্ক্রল করার কারণে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতাও তার কমতে থাকে। তাই শিশু একেবারে ছোট থাকতেই এই ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। ইন্টারনেট অন করার সময় wifi/mobile data এর আইকন গুলি শিশুরর সামনে টিপবেন না। একবার যদি সে দেখে ফেলে কোন বাটন চাপলে ইন্টারনেট অন হয়, তখন সে নিজেই wifi অন করে দেখা শুরু করবে। শিশুদের বোকা ভাববেন না।

২. বাবা-মায়েরা বলেন যে ইন্টারনেট না থাকলে শিশু মোবাইল/ ট্যাব এ কি দেখবে? আপনি তার বয়স এবং আমাদের সংষ্কৃতির সাথে এর সাথে উপযোগী কিছু কনটেন্ট/ভিডিও ডাউনলোড করে দেবেন, সেই ভিডিওগুলোই সে দেখবে। এক মাস পর পর আগের ভিডিও ডিলিট করে নতুন ভিডিও ডাউনলোড করুন নতুবা সে বোরড হয়ে যাবে।

৩. শুধুমাত্র ইউটিউব না দেখিয়ে তাকে খেলার ছলে শেখায় এরকম কিছু app ব্যবহার করতে দিন। যেমন: Khan academy kids, ABC kids, Piano Kids. এতে তার ভিডিওর প্রতি আসক্তি তৈরি হবেনা।

৪. আপনার মোবাইলের পাসওয়ার্ড/ প্যাটার্ণ লক যেন শিশু না জানে সেই বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকুন, শিশুর সামনে মোবাইলে পাসওয়ার্ড/প্যাটার্ণ দেবেন না। কোনভাবে শিশু যদি জেনে ফেলে, পাসওয়ার্ড/ প্যাটার্ণ লক পরিবর্তন করুন।

৫. শিশু যখন স্ক্রিন দেখবে, তখন ও তার সাথে Interact করুন। যেন সে একদৃষ্টে নিবিড় মনোযোগের সাথে স্ক্রিন না দেখতে পারে। এটাকে বলা হয় Processed Screen Time. যেমন: সে ‘ম্যারি হ্যাড এ লিটল ল্যাম্ব’ এর ভিডিও দেখছে, আপনি তাকে বলুন, বাহ কি সুন্দর একটা ভেড়া, ওর নাম কি? ওর গায়ের রঙ কি?

৬. শিশু স্ক্রিন দেখার সময় তার আশে পাশে থাকার চেষ্টা করুন। আপনি এক রুমে কাজ করছেন, শিশু আরেক রুমে বসে নিবিষ্টভাবে স্ক্রিন দেখছে, এটা যেন না হয়। একেবারেই অপারগ হলে তাকে এই সময় টিভি দেখতে দিন, মোবাইল/ট্যাব নয়।

৭. শিশুকে তার নিজস্ব ডিভাইস দেবেন না। অর্থাৎ একটি মোবাইল/ট্যাব/ আই প্যাড যেটা একান্তই তার নিজের, আর কেউ সেটা ব্যবহার করেনা, এমনটা যেন না হয়। কোথাও বেড়াতে গেলে সর্বক্ষণ তাকে ডিভাইস দিয়ে রাখবেন না। তাকে প্রকৃতির সাথে মিশতে দিন, অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে মিশতে দিন। ডিভাইস হাতে থাকলে সে আর কোনদিকেই মনোযোগ দেবেনা।

৮. শিশু কতক্ষণ টিভি/মোবাইল/ ট্যাব দেখবে সেটা দেখার আগেই সময় বেঁধে দিন এবং সেটা strictly মেনে চলুন। আপনি যদি তাকে বলেন, তোমাকে আধা ঘন্টার জন্য মোবাইল/ টিভি দেখতে দিলাম, তাহলে ঠিক আধা ঘন্টা পরেই এটা ফেরত নিন। ফেরত নেবার সময় শিশু দিতে চাইবেনা, কান্নাকাটি করবে, আরো একটু সময় চাইবে, তাতে গলে যাবেন না।

৯. অনেক শিশু আছে স্ক্রিন না দেখলে কিছুতেই খায় না। তাঁদেরকে নিজের হাতে মাঝে মাঝে খাবার খেতে দিন, খাবার হয়ত অল্প খাবে কিন্তু তার সু-অভ্যাস গড়ে উঠবে। এক বেলা স্ক্রিন সহ খাওয়ালে অন্য বেলায় স্ক্রিন ছাড়া খাওয়ানোর চেষ্টা করুন।

১০. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটি সবার শেষে বলছি। বাবা-মায়ের নিজেদের ডিভাইস আসক্তি কমাতে হবে। একটি শিশু যদি তার বাবা-মাকে দিনের বেশিরভাগ সময় ডিভাইস ব্যবহার করতে দেখে, তাহলে সে নিজেও তাই করবে। আপনি শিশুকে যা শেখাতে চান, আপনি নিজে আগে তা করুন।

** উল্লখ্য যে ওপরের সবগুলি পয়েন্ট স্বাভাবিক বিকাশের শিশুদের জন্য প্রযোজ্য। যেসব শিশুরা কথা দেরিতে বলছে (স্পিচ ডিলে), চোখে চোখে তাকায় না, অন্য শিশুদের সাথে interact করেনা, ডাকলে ঠিকভাবে সাড়া দেয় না, তাদের জন্য স্ক্রিণ টাইম শূণ্যতে নিয়ে আসতে হবে।

মনে রাখবেনঃ

ডিভাইস/স্ক্রিন human interaction এর বিকল্প নয়। শিশুকে প্রচুর সময় দিবেন, তার সাথে খেলবেন, কথা বলবেন, ছড়া শোনাবেন, গান শোনাবেন। তাকে ধর্ম শিক্ষা দিন, আমাদের সংষ্কৃতির সাথে পরিচিত করান, তাকে বাসার বাইরে মাঝে মাঝে খেলাধুলা করতে নিয়ে যান।

ডিভাইস আমাদের অতি ব্যস্ত জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ, কিন্তু শিশুর ক্ষেত্রে যতটা কম সম্ভব স্ক্রিন ব্যবহার করবেন, ততই মংগল। পরিবারের সদস্যদের সাথে গুণগত সময় কাটানোর কোন বিকল্প নেই।

লেখকঃ

ডা. সিফাত ই সাইদ
সহকারী অধ্যাপক,
মনোরোগ বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। 


আরও দেখুন: