পাকস্থলীর ক্যান্সার একটি নীরব ঘাতক

ডা. মো. তৌছিফুর রহমান
2023-08-18 11:45:36
পাকস্থলীর ক্যান্সার একটি নীরব ঘাতক

পাকস্থলীর ক্যান্সার (ইনসেটে লেখক)

বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর চতুর্থ সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ পাকস্থলী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ পাকস্থলী ক্যান্সারে মৃত্যুবরন করেন। দেখা যায়- জাপান কোরিয়া,চায়না, আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা ও ইস্টার্ন ইউরোপে মানুষের মধ্যে পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি । পঞ্চাশোর্ধ মানুষের মধ্যে পাকস্থলী ক্যান্সার বেশি হয়ে থাকে। সাধারণত পুরুষের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি দেখা যায় । 

পাকস্থলী ক্যান্সারের কারণগুলো কি কি?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারণ জানা যায় না। তারপরও যে কারণগুলো রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ
*প্রথমতঃ খাদ্যাভ্যাস এর জন্য দায়ী। যেসব মানুষ নাইট্রেট, নাইট্রাইট সমৃদ্ধ খাবার, অতিরিক্ত লবনযুক্ত খাবার, ধোয়াযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত মসলা জাতীয় খাবার বেশি খান। 

* এরপর, হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি ব্যাক্টেরিয়া দিয়ে পেপটিক আলসার হলে। এপস্টেন বার ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে গ্যাস্ট্রিক লিম্ফোমা হতে পারে।

* জেনেটিকঃ পারিবারিক ইতিহাস থাকলে। P53, APC জীন মিউটেশন হলে। দেখা যায় বেশিরভাগ পাকস্থলির ক্যান্সারেই এই দুই ধরনের মিউটেসন থাকে।

* গ্যাস্ট্রিক পলিপ থাকলেঃ গ্যাস্ট্রিক পলিপ কয়েক ধরনের হতে পারে। এর মধ্যে কিছু  ইনফ্লামেটরি, হাইপারপ্লাস্টিক, অ্যাডেনোমাটাস, সিসাইল পলিপ অন্যতম। ইনফ্লামেটরি পলিপ ছাড়া যেকোনো পলিপেই ক্যন্সার হবার সম্ভাবনা থাকে।

* পাকস্থলির অপারেশন হয়েছে এমন মানুষের ক্ষেত্রেও ১৫-২০ বছর পর ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। যেমনঃ আগে পেপটিক আলসার এর জন্য পার্সিয়াল গ্যাস্ট্রেকটমি অপারেশন করা হতো যা পাকস্থলির ক্যান্সারের ঝুকি বৃদ্ধি করতো।


* এছাড়া যারা Chronic Gastritis, Pernicious Anemia, Chronic Gastric ulcer এ আক্রান্ত তাদেরও উচ্চ ঝুকি রয়েছে।

* ধূমপানঃ অন্যতম কারণ, ধূমপায়ীদের মধ্যে উচ্চ ঝুকি রয়েছে।

* জেনেটিক সিনড্রোমঃ FAP (Familial Adenomatous Polyposis), HNPCC(Hereditary Nonpolyposis Colon Cancer),Peutz jeghars syndrome পরিবারে কারো যদি এসব সিনড্রোম থাকে তাহলে অবশ্যই সতর্ক থাকা উচিত অন্যদেরও। কারণ এক্ষেত্রে প্রায় ৭০-৮০ ভাগ সম্ভাবনা থাকে অন্যদেরও পাকস্থলির ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার।

* বিকিরন এ উন্মুক্ত হলেঃ অল্প বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে এবং বিকিরন দিয়ে চিকিৎসা করা হলে। যেমন লিম্ফোমার চিকিৎসায় বিকিরন দিলে পরবর্তীকালে পাকস্থলির ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন।


পাকস্থলী ক্যান্সারের লক্ষণসমূহ কি কি?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাথমিক অবস্থায় কোনো লক্ষন প্রকাশ পায় না। সাধারনত সুনির্দিষ্ট লক্ষন নাও থাকতে পারে।

* রক্ত কমে যাওয়া, 

* অতিরিক্ত শারীরিক দুর্বলতা।  

* ক্ষুধামন্দা থাকতে পারে।

* বমি বমি ভাব ও বমি হওয়া।  

* বমির সাথে রক্ত যাওয়া। 

* পেটের উপরের দিকে ব্যাথা যা সাধারনত খাবার খেলে বাড়ে।

* উপর পেটে চাকা হওয়া, অতিরিক্ত দর্গন্ধযুক্ত ও আলকাতরার মতো পায়খানা হওয়া।

এছাড়া ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লে 

* পেট ফুলে যাওয়া।
* শ্বাসকষ্ট হওয়া। 
* মাথাব্যাথা। 
* মেরুদ্বন্ডের হাড়ে ব্যাথা ইত্যাদি হতে পারে।


সনাক্তকরনের পদ্ধতিঃ

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এন্ডোস্কপিক বায়োপসি পরীক্ষার মাধ্যমে পাকস্থলিতে ক্যান্সার ও তার ধরন জানা যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে সিটি গাইডেড বায়োপসি পরীক্ষার মাধ্যমে ও নির্ণয় করা হয়।

রোগটি কতটুকু ছড়িয়েছে দেখার জন্য বুক ও পেটের সিটি স্ক্যান, পেট সিটি স্ক্যান পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া কিছু সাধারন রক্ত পরীক্ষা, এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রাম,ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম ও টিউমার মার্কার পরীক্ষা করা হয়।


চিকিৎসাসমূহ কি কি? 

চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে

* কেমোথেরাপি।  

* রেডিওথেরাপি।  

* সার্জারী। 

* ইমিউনোথেরাপি।

এমনিতে এবং চিকিৎসা চলাকালিন অবস্থায়ও একজন পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যাক্তির তীব্র অপুষ্টিজনিত ওজনহীনতা দেখা দিতে পারে। সুতরাং তার শরীরের পুষ্টি ঠিক রাখতে বিকল্প পন্থায় খাওয়ার জন্য অনেক সময় সার্জারি করা হয়ে থাকে। এধরনের রোগীদের অল্প অল্প করে বার বার খাবার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।


প্রতিরোধের উপায়সমূহ কি কি? 

উপরোক্ত ঝুকিসমূহ এড়িয়ে চলতে হবে। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন পদ্ধতি ঠিক রাখতে হবে। যাদের পলিপের পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে তারা নিয়মিত স্ক্রিনিং করবে ও কিছু ঔষধ আছে যা খেলে পলিপ অনেকাংশে দূর হয়ে যায় এবং পাকস্থলির ক্যান্সার হবার প্রবনতা হ্রাস পায়।


পাকস্থলীর ক্যান্সার খুবই আগ্রাসী একটা ক্যান্সার। এর ভয়াবহতা থেকে মুক্ত থাকতে হলে সচেতন হতে হবে। 


মনে রাখবেন ক্যান্সার অন্যান্য অসংক্রামক রোগের মতই একটি রোগ,
সচেতনতায় এর প্রতিরোধ ও সুচিকিৎসায় নিরাময় সম্ভব।


আসুন নিজে সচেতন হই, পরিবার ও সমাজকে সচেতন করি। আমার আপনার "সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দূর হোক ক্যান্সার চিকিৎসার সকল অন্তরায়"।

 

জন সচেতনতায়ঃ

ডা. মো. তৌছিফুর রহমান 
এম.বি.বি.এস (শসোমেক), সি.সি.ডি (বারডেম), এম.ডি (অনকোলজি) বি.এস.এম.এম.ইউ ।
সহকারী অধ্যাপক (ক্যান্সার রোগ বিশেষজ্ঞ)
টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ও ক্যান্সার সেন্টার, বগুড়া।

চেম্বারঃ ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক & কনসালটেশন সেন্টার, বগুড়া।


আরও দেখুন: