ফুসফুসের ক্যান্সারের আদ্যোপান্ত
ফুসফুসের ক্যান্সারের আদ্যোপান্ত (ইনসেটে লেখক)
১. ফুসফুসের ক্যান্সার কি?
ফুসফুস ক্যান্সার একটি মারাত্মক রোগ যাতে ফুসফুসের টিস্যুগুলিতে অনিয়ন্ত্রিত কোষবৃদ্ধি ঘটে। এই বৃদ্ধির ফলে প্রথমে ফুসফুসের কোষ, প্রতিবেশী কোষ আক্রমণ এবং পরবর্তিতে ফুসফুসের বাইরে সংক্রমণ ঘটতে পারে।
২. ফুসফুসের ক্যান্সার কেন হয়?
• ধূমপান, সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয় ধূমপান উভয়ই।
• মদ্যপান
• ফুসফুসের ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস।
• রেডন গ্যাস, অ্যাসবেস্টস এবং অন্যান্য কার্সিনোজেনের সংস্পর্শ।
৩. ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ বা উপসর্গ গুলো কি কি?
• দীর্ঘদিন ধরে কাশি
• কাশির সাথে রক্ত যাওয়া
• বুকে ব্যথা
• শ্বাসকষ্ট
• ক্ষুধামন্দা
• ওজন হ্রাস
• শারীরিক দুর্বলতা
৪. ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসাঃ
• সার্জারিঃ ফুসফুস ক্যান্সারে বিশেষত প্রাথমিক পর্যায়ে, যখন রোগ যখনও স্থানীয় পর্যায়ে থাকে তখন সার্জারি হস্তক্ষেপের পছন্দসই লাইন হিসাবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও ক্যান্সারের মেটাস্টেসিস পরীক্ষা করতে বুকের লিম্ফ নোডগুলিও সরানো যেতে পারে।
• কেমোথেরাপিঃ কেমোথেরাপি হল ক্যান্সারবিরোধী ওষুধের ব্যবহার যা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী দ্রুত বিভাজনকারী কোষগুলির বৃদ্ধি ধীরগতিতে বা বন্ধ করতে সহায়তা করে। এটি বিভাজনকোষকে হত্যা করে দ্রুত বিভাজনকারী কোষগুলির বৃদ্ধি রোধ করে। এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও, কেমো এখনও সর্বাধিক ব্যবহৃত ক্যান্সার চিকিৎসার বিকল্প। রেডিয়েশন এবং সার্জারি থেকে পৃথক যা নির্দিষ্ট স্থানে ক্যান্সার কোষগুলির সাথে আচরণ করে, কেমোথেরাপির ওষুধগুলি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গগুলিতে মেটাস্টেট (ছড়িয়ে পড়ে) থাকা ক্যান্সার কোষকে হত্যা করতে পারে।
• রেডিয়েশন থেরাপিঃ এটি এক ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসা যা টিউমারগুলি সঙ্কুচিত করার জন্য ক্যান্সার কোষগুলিকে মেরে ফেলতে উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন বীম ব্যবহার করে। রেডিয়েশন ডিএনএ (DNA) ধ্বংস করে ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলে। ক্ষতিগ্রস্থ ডিএনএ (DNA) যুক্ত ক্যান্সার কোষগুলি সংখ্যাবৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয় এবং মারা যায়। তারপরে এগুলি শরীরের প্রক্রিয়া দ্বারা সরানো হয়।
• স্টেরিওট্যাকটিক রেডিওসার্জারিঃ স্টেরিট্যাকটিক রেডিওসোজারি (SRS) রেডিয়ো-সার্জারির একটি উন্নত রূপ। যেখানে খুব উচ্চমাত্রায় বিকিরণের ডোজগুলি মাল্টি ডাইমেনশনাল ইমেজিং ব্যবহার করে কোনও লক্ষ্যস্থানে বিকিরণ করা হয়। স্টিরিওট্যাকটিক রেডিওসার্জারি ক্যান্সার কোষগুলিকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে সহায়তা করে যার সাথে আশপাশের স্বাস্থ্যকর টিস্যুগুলির সর্বনিম্ন বা কোনও ক্ষতি হয় না।
• টার্গেটেড থেরাপিঃ এটি প্রচলিত কেমোথেরাপির থেকে পৃথক, যা ক্যান্সার কোষগুলি মারতে সাহায্য করে। টার্গেটেড থেরাপিতে ক্যান্সারের নির্দিষ্ট জিন, প্রোটিন বা ক্যান্সারের বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার জন্য অবদান রাখে এমন টিস্যু পরিবেশকে লক্ষ্য করা হয়। লক্ষ্যযুক্ত থেরাপিটি সাধারণত কেমোথেরাপি এবং অন্যান্য হস্তক্ষেপের সাথে ব্যবহৃত হয়।
• ইমিউনোথেরাপিঃ এটি (বায়োলজিক থেরাপি নামেও পরিচিত) একটি নতুন ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসা যেখানে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাড়িয়ে তোলা হয় শরীরকে নিজেই ক্যান্সারের সাথে লড়াই করতে সহায়তা করার জন্য। ইমিউনোথেরাপি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সিস্টেমের কার্যকারিতা উন্নতি বা পুনরুদ্ধার করতে শরীর দ্বারা বা পরীক্ষাগারে তৈরি পদার্থ ব্যবহার করে।
• প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা উপশমকারীঃ প্যালিয়েটিভ কেয়ার ক্যান্সারের মতো গুরুতর অসুস্থতার ব্যথা এবং অন্যান্য লক্ষণগুলি হ্রাস করার জন্য বিশেষ চিকিৎসা। কেমো, রেডিয়েশন ইত্যাদির মতো অন্যান্য আক্রমণাত্মক ব্যবস্থাগুলির পাশাপাশি উপশম যত্ন দেওয়া যেতে পারে। এটি ব্যথা হ্রাস করে এবং রোগীর জীবনমান উন্নত করে।
৫. বাংলাদেশে চিকিৎসার সুযোগ কতটুকু? সরকারি-বেসরকারি কোন কোন হাসপাতালে চিকিৎসা হয়ে থাকে?
বাংলাদেশে ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রচলিত সব ধরনের চিকিৎসা যেমন-সার্জারি, কেমোথেরাপী, রেডিওথেরাপী, টার্গেটেড থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি বিদ্যমান। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে ডেল্টা হাসপাতাল, স্কয়ার, ইউনাইটেড হাসপাতাল ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় উন্নত চিকিৎসা বিদ্যমান।
৬. রোগীদের জন্য চিকিৎসক হিসাবে পরামর্শঃ
ক্যান্সার হলে ভয় না পেয়ে অতি দ্রূত চিকিৎসকের শরনাপন্ন হবেন। ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রচলিত সব ধরনের চিকিৎসা এখন বাংলাদেশেই করা সম্ভব। প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার ধরা পরলে এবং যথযথ চিকিৎসা গ্রহন করলে এই রোগ নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব।
৭. রোগীদের জন্য চিকিৎসা পরবর্তী পরামর্শঃ
চিকিৎসা শেষে নিয়মিত ফলোআপ, ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার, নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন, পরিমিত খাদ্যাভাস ও নিয়মিত শরীরচর্চার মাধম্যে সুস্থ থাকা যায়।
৮. রোগীর স্বজনদের করনীয়ঃ
ক্যান্সার রোগীদের জন্য সঠিক চিকিৎসার পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার, মানসিক সহায়তা ও আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান জরুরী। এটি কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়, তাই রোগীর জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিন, তাকে সাহস দিয়ে পাশে থাকুন।
লেখক :
ডা. শামীমা আফরোজ তৃনা
এমবিবিএস,এফসিপিএস (রেডিওথেরাপী)
কনসালটেন্ট ও এসিস্টেন্ট প্রফেসর
ক্লিনিক্যাল অনকোলজী বিভাগ
ডেল্টা হাসপাতাল লিমিটেড।