ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসা ও উত্তর

ডা. আবুল ফয়সাল মোহাম্মদ নুরুদ্দীন চৌধুরী
2023-07-10 12:18:19
ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসা ও উত্তর

ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসা ও উত্তর (ইনসেটে লেখক)

দেশে প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হচ্ছে। দিনদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সংক্রমণটিকে মোটেই অবহেলা করার মতো নয়। কারণ, এটি গুরুতর পর্যায়ে চলে গেলে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। স্বাভাবিকভাবেই ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে মানুষের মাঝে প্রবল উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।


১. ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো কী?


সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেবার পর আবারো জ্বর আসতে পারে। এর সাথে শরীরে ব্যথা, মাথাব্যথা, চেখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে দাগ (র‍্যাশ) হতে পারে।মাংসপেশি এবং অস্থি সন্ধি (bone) তে যন্ত্রণা , বমি হওয়া অথবা বমি ভাব , পেট ব্যথা থাকতে পারে।
তবে এগুলো না থাকলেও ডেঙ্গু হতে পারে।


২. জ্বর হলেই কি চিন্তিত হবেন?


এখন যেহেতু ডেঙ্গুর সময়, সেজন্য জ্বর হল অবহেলা করা উচিত নয়।জ্বরে আক্রান্ত হলেই সাথে-সাথে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, তারা জ্বরকে অবহেলা করেছেন। জ্বরের সাথে যদি সর্দি- কাশি, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কিংবা অন্য কোন বিষয় জড়িত থাকে তাহলে সেটি ডেঙ্গু না হয়ে অন্যকিছু হতে পারে। তবে জ্বর হলেই সচেতন থাকতে হবে।


৩. বিশ্রামে থাকতে হবেঃ


জ্বর হলে বিশ্রামে থাকতে হবে।একজন ব্যক্তি সাধারণত প্রতিদিন যেসব পরিশ্রমের কাজ করে, সেগুলো না করাই ভালো। পরিপূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন।


৪. কী খাবেন?


প্রচুর পরিমাণে তরল বা তরল জাতীয় জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন - ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের জুস এবং খাবার স্যালাইন গ্রহণ করা যেতে পারে। এমন নয় যে প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে, পানি জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে।


সহজে হজম হয়না এমন খাবার ডেঙ্গু রোগীদের খাওয়া উচিত নয়। যেমন - আমিষ খাবার, চর্বি,  নতৈলাক্ত খাবার, ভাজাভুজি।


৫. যেসব ঔষধ খাওয়া উচিত নয়ঃ


ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। স্বাভাবিক ওজনের একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ চারটি প্যারাসিটামল খেতে পারবে।'' প্যারাসিটামলের সর্বোচ্চ ডোজ হচ্ছে ওজন ভেদে প্রতিদিন তিন/চার গ্রাম। 

কিন্তু কোন ব্যক্তির যদি লিভার, হার্ট এবং কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।


ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ খাওয়া বা কোন ব্যথা নাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না । ডেঙ্গুর সময় অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ গ্রহণ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে।


৬.​ ডেঙ্গুর টেস্ট কখন করা উচিত?


জ্বর আসার পর করতে হবে টেস্ট (Dengue Test)। 
সেক্ষেত্রে প্রথমে করতে হয় ডেঙ্গুর NS1 Antigen test,
জ্বর আসার দিন থেকেই এই টেস্ট করতে পারেন। সব জায়গাতেই এই পরীক্ষা করা সম্ভব। এই টেস্ট জ্বর আসার সর্বোচ্চ চার দিনের মধ্যে করতে হবে, এরপর করলে এটা নেগেটিভ আসতে পারে।


পরবর্তীতে করতে পারেনঃ

IGM Dengue Antibody.. এই টেস্ট রোগী শরীরে জ্বর আসার পাঁচ দিন  থেকে পজিটিভ আসতে পারে, জ্বর আসার পঞ্চম দিন থেকে ডেঙ্গুর IGM Dengue Antibody.. করতে হয়। এছাড়া কিছু জরুরী পরীক্ষা শুরু থেকেই করতে হয়, যেমন CBC,SGPT.. জ্বরের সাথে অন্যান্য লক্ষণ দেখা দিলে সে ক্ষেত্রে চিকিৎসক আরো কিছু পরীক্ষার  পরামর্শ দিতে পারেন।​


৭. প্ল্যাটিলেট বা রক্তকণিকা নিয়ে চিন্তিত?


ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে প্ল্যাটিলেট বা রক্তকণিকা এখন আর মূল ফ্যাক্টর নয় ,প্ল্যাটিলেট কাউন্ট নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কোন প্রয়োজন নেই। বিষয়টি চিকিৎসকের উপর ছেড়ে দেয়াই ভালো। চিকিৎসক  প্ল্যাটিলেটের পাশাপাশি রক্তের আরো কিছু উপাদানও দেখেন যেমন WBC, HCT, । সাধারণত একজন মানুষের রক্তে প্ল্যাটিলেট কাউন্ট থাকে দেড়-লাখ থেকে সাড়ে চার-লাখ পর্যন্ত।প্লাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজারের নিচে নামলে বা শরীরের কোনো জায়গা থেকে রক্তপাত হলে প্রয়োজন বোধে প্লাটিলেট বা ফ্রেশ রক্ত দেওয়া যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি খুবই কম দেখা যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নিবেন।


৮. ডেঙ্গু হলেই কি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়?


ডেঙ্গু জ্বরের তিনটি ভাগ রয়েছে। এ ভাগগুলো হচ্ছে - 'এ', 'বি' এবং 'সি'।


প্রথম ক্যাটাগরির রোগীরা নরমাল থাকে। তাদের শুধু জ্বর থাকে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী 'এ' ক্যাটাগরির।


তাদের হাসপাতালে ভর্তি হবার কোন প্রয়োজন নেই। 


'বি' ক্যাটাগরির ডেঙ্গু রোগীদের সবই স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু শরীরে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন তার পেটে ব্যথা হতে পারে, বমি হতে পারে প্রচুর কিংবা সে কিছুই খেতে পারছে না। এদের হাসপাতালে নিতে হবে

অনেক সময় দেখা যায়, দুইদিন জ্বরের পরে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এক্ষেত্রে হাসপাতাল ভর্তি হওয়াই ভালো।


'সি' ক্যাটাগরির ডেঙ্গু জ্বর সবচেয়ে খারাপ। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ'র প্রয়োজন হতে পারে।

 


৯. ডেঙ্গুর জ্বরের সময়কালঃ


সাধারণত জুন থেকে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ থাকে। কারণ এ সময়টিতে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গু জ্বরের সময়কাল আরো এগিয়ে এসেছে। এখন এপ্রিল মাস থেকেই ডেঙ্গু জ্বরের সময় শুরু হয়ে যাচ্ছে।


১০. এডিস মশা কখন কামড়ায়ঃ


ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা অন্ধকারে কামড়ায় না। সাধারণত সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার কিছু আগে এডিস মশা তৎপর হয়ে উঠে। এ সময় বাড়তি সতর্কতা নেয়া প্রয়োজন।


১১. পানি জমিয়ে না রাখাঃ


এডিস মশা সাধারণত ডিম পাড়ে স্বচ্ছ পানিতে। কোথাও যাতে পানি তিন থেকে পাঁচদিনের বেশি জমানো না থাকে। মশার বংশবিস্তার রোধ করা, বাড়ির আঙ্গিনা, উঠোন বারান্দা পরিষ্কার রাখা, ফুলের টব, টায়ার এগুলোতে যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখা। 


আরও দেখুন: