গুরুতর এলার্জি হলে বুঝবেন কীভাবে?
গুরুতর এলার্জি হলে বুঝবেন কীভাবে
আমরা মানুষরা আমাদের অজান্তেই অজস্র নিযুত বস্তুকণার রাজ্যে ডুবে থাকি। এসব বস্তুকণা এত ক্ষুদ্র যে, সাধারণ চোখে দেখা যায় না। এগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রতিদিনকার ব্যবহার্য আসবাবপত্র বা সাবান কসমেটিক ইত্যাদির মধ্যে, কোনটা লুকিয়ে আছে খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে, আবার অনেক ধরনের বস্তুকণা ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসের মধ্যে। এ বস্তুকণাগুলো যখন শরীরের সংস্পর্শে আসে তখন শরীর দু’ভাবে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে: প্রথমত: শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা এটাকে সহজ ভাবে শরীরের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। দ্বিতীয়ত: শরীরের ইমিউন সিস্টেম এসব জিনিসের প্রতি অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়াই আসলে এলার্জি। আর যেসব বস্তুকণা এলার্জি সৃষ্টি করে তাদেরকে বলে এলার্জিকণা। নানা জিনিস থেকে এ এলার্জিকণার উদ্ভব হতে পারে: যেমন পুরনো জিনিসপত্রে বা পুরনো খাদ্যদ্রব্যে জড়িয়ে থাকা ফাঙ্গাল স্পোর, ফুলের পরাগ, গাছপালা বা ঘাস থেকে নিঃসরিত পলেন নামক এলার্জিকণা, দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত ডিটারজেন্ট এবং ক্লিনজার ইত্যাদি।
এলার্জিকণা আমাদের শরীরের সংস্পর্শে আসে মূলত চারভাবে: ত্বক, নাক ও শ্বাস নালি, চোখ ও মুখ গহবর-খাদ্যনালী। তাই এলার্জির প্রধান উপসর্গগুলো ও এসব অঙ্গগুলোকে ঘিরে আবর্তিত হয়।
এলার্জির প্রধান কিছু উপসর্গ:
সর্দি ও নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া
গুরুতর এলার্জির প্রাথমিক লক্ষণের মধ্যে একটি হলো নাকের ভেতরের ত্বক এলার্জির কারণে ফুলে যাওয়া এবং এতে সর্দি হয়ে নাক বন্ধ হওয়ার উপসর্গ তৈরি হওয়া। শ্বাসের সঙ্গে নেয়া বাতাসে যে ক্ষুদ্র এলার্জিকণা থাকে, তার প্রতিক্রিয়ায় এটা ঘটে।
অবশ্য কোনো ঔষধের প্রতিক্রিয়ায়ও এটা হয়। ঔষধ গ্রহণের এক ঘণ্টা পর যদি নাক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় তবে বুঝতে হবে, এটা এই ওষুধের প্রতিক্রিয়া।
হাঁচি
যদিও হাঁচিকে খুব একটা বড় ব্যাপার বলে মনে হয় না। তবে এটি এলার্জির একটি প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে হাঁচি দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে আরও গুরুতর উপসর্গের দিকে যেতে পারে।
চোখে চুলকানি
বিভিন্ন মৌসুমে বিশেষত বসন্তকালে যখন বাতাসে এলার্জিকণার উপস্থিতি বেড়ে যায়, তখন নাকের মতো চোখের বহির আবরণ বা কংজানটিবায় চুলকাতে পারে বা সময়ে সময়ে অশ্রুতে ভরে যেতে পারে। বসন্তকালে বাতাসে উড়ে বেড়ানো পরাগরেণু এ সময়ের এলার্জির অন্যতম কারণ। গুরুতর এলার্জির প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে অনেক সময় চোখের চুলকানি লক্ষ্য করা যায়।
কান বা মুখ চুলকানো
অনেক সময় নতুন কোনো খাবার খাওয়ার পরেই হঠাৎ চুলকানি হয়। চোখ ও মুখের এই চুলকানি ধীরে ধীরে গুরুতর অ্যালার্জির দিকে যেতে পারে।
শ্বাস পরিবর্তন
হঠাৎ শ্বাসকষ্ট অথবা শ্বাস পুরোপুরি ধরে রাখতে না পারা, সবসময়ই স্বাস্থ্যের জন্য একটি খারাপ লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। গুরুতর এলার্জির কারণে এটি প্রায়ই ঘটে থাকে।
আমবাত বা আরটিকারিয়া
ত্বকে হঠাৎ লাল চাকা ও চুলকানি হতে পারে। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ওষুধ, রাসায়নিক, খাবার বা অন্য কিছুর প্রতি অ্যালার্জি। আমবাত সব সময় গুরুতর নাও হতে পারে, কিন্তু যদি একই সঙ্গে ফোলা ঠোঁট ফুলে যায় বা শ্বাসকষ্ট হয়, তবে এটিকে গুরুতর এলার্জির একটি সংকেত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
চামড়ায় ফুসকুড়ি
চামড়ায় হঠাৎ ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। এগুলোতে প্রচুর চুলকানি থাকে, কখনো এর থেকে ফোস্কা সৃষ্টি হয় । সাধারণত পোষা প্রাণীর খুশকি, রাসায়নিক, খাবার, ওষুধ বা মেকআপের অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়ায় এ উপসর্গ তৈরি হয়। সাধারণত এগুলো মৃদু চিকিৎসায়ই সেরে যায়। তবে কখনো কখনো এটিও গুরুতর এলার্জি বা অ্যানাফিল্যাক্সিসের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে, যা জীবনকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
বমি বমি ভাব, বমি, ডায়রিয়া
একটি নির্দিষ্ট খাবার খাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই বমি বমি ভাব, বমি, ডায়রিয়া এবং পেটে ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দিলে এটা অনেক সময় এলার্জির সংকেত হতে পারে এবং এ উপসর্গগুলো অনেক সময় দ্রুত খারাপ হতে থাকে। এগুলোও তীব্র এলার্জি বা অ্যানাফিল্যাক্সিসের লক্ষণ, তাই এটাকে সাধারণ পেটের অসুখ হিসেবে ঝেড়ে ফেলা যাবে না।
বুক টানটান হওয়া
কখনো কখনো আপনার বুক হঠাৎ শক্ত হয়ে যায় বা শ্বাস নেয়ার সময় ব্যথা হয়। আপনার গলাও আঁটসাঁট বা সংকুচিত হতে পারে। এটি গুরুতর খাদ্য অ্যালার্জির একটি সাধারণ লক্ষণ। যখন এটি ঘটে, তখনই চিকিৎসা সহায়তা নেয়া উচিত।
জিহ্বা বা ঠোঁট ফুলে যাওয়া
যদি মুখ, ঠোঁট বা জিহ্বা কোনো আপাতকারণ ছাড়াই ফুলে ওঠে, তাহলে এটি অ্যাঞ্জিওইডিমা হতে পারে। এনজিওইডিমাপিমা তীব্র অ্যালার্জির একটি অবস্থা। এটা সবসময় গুরুতর হয় না। কিন্তু যদি শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তাহলে তা প্রাণঘাতী হতে পারে। যদি ঠোঁট বা জিহ্বা প্রায়ই ফুলে যায়, তাহলে চিকিৎসককে অবশ্যই জানাতে হবে।
ফ্লাশড বা লালচে স্কিন
খাবারের অ্যালার্জি মুখ এবং চোখের চারপাশে লালভাব সৃষ্টি করতে পারে। কোনো এলার্জি খাবার গ্রহণের পর বা এলার্জিক বস্তুকণার সংস্পর্শে আসার পর পরই যদি ত্বক দ্রুত ফ্লাশ বা লাল হয়ে যায়, তাহলে এর অর্থ হতে পারে অ্যালার্জি গুরুতর। দ্রুত চিকিৎসা নিন, লালভাব চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করবেন না।
হঠাৎ বিভ্রান্ত বা উদ্বিগ্ন হওয়া
অদ্ভুত শোনালেও হঠাৎ বিভ্রান্তি বা ধ্বংসের অনুভূতি হওয়া একটি গুরুতর খাদ্য অ্যালার্জির লক্ষণ। এ সময় রক্তচাপ হঠাৎ কমে যেতে পারে। এই লক্ষণটি লক্ষ্য করার সঙ্গে সঙ্গে অবিলম্বে চিকিৎসা সহায়তা নিন। অন্যথায় আপনার জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
গুরুতর অ্যালার্জি সব সময়ই স্বাস্থ্যের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ সমস্যা। উন্নত বিশ্বে এ সমস্যাগুলো মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দেশে এখনোও অপ্রতুল। মনে রাখতে হবে গুরুতর এলার্জি সবসময়ই একটি জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা এবং চিকিৎসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে অযথা সময় ব্যয় না করে অতি দ্রুত কোনো একটি হাসপাতালে স্থানান্তরিত হওয়া। একজন এলার্জি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো চিকিৎসা নিয়ে এলার্জির মূল কারণগুলো খুঁজে বের করুন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের এলার্জি হলে জরুরি করণীয় বিষয়ে বিশেষভাবে অবহিত হোন।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুল হাই
(চর্ম, যৌন ও এলার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ) জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
চেম্বার: ১২, স্টেডিয়াম মার্কেট, সিলেট। ফোন: ০১৭১২-২৯১৮৮৭