হার্ট ফেইলিওরের আধুনিক চিকিৎসা

ডা. মাহবুবর রহমান :
2023-05-05 10:47:23
হার্ট ফেইলিওরের আধুনিক চিকিৎসা

হার্ট ফেইল্যুর এর আধুনিক চিকিৎসা বিষয়ে লিখেছেন ডা. মাহবুবর রহমান

হার্ট ফেইলিওর কথাটা শুনলেই আমাদেরকে একটা আতঙ্ক ছুঁয়ে যায়। হার্ট নেই তো জীবনও নেই। এমন এক আতঙ্ক থেকে আমরা বাঁচব কী করে?

বাস্তবে হার্ট ফেইলিওর একটি চিকিৎসাযোগ্য রোগ। সঠিক রোগ নির্ণয়, সঠিক চিকিৎসায় রোগীরা প্রায় স্বাভাবিক জীবন যাপনে সক্ষম।

এবার তবে আসা যাক হার্ট ফেইলিওর রোগটা কী, তার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা কী সে সম্পর্কে একটা ধারণা অর্জন করা যাক।

হার্ট ফেইলিওর কী এবং কেন :

হার্টের মূল কাজ হলো শরীরের প্রতিটি কোষে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও খাদ্য সরবরাহ করা। সেটি করতে হলে তার পাম্পিং শক্তি কার্যকর থাকা চাই। পাম্প করতে হলে শক্তিশালী মাংসপেশি অত্যাবশ্যক। মাংসপেশি কাজ করতে গেলে করোনারী ধমনী সচল ও বাধাহীন হতে হবে। বিভিন্ন রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল ইত্যাদি কারণে ধমনীর গাত্র অমসৃণ ও চর্বির দলা জমে বিভিন্ন স্থানে বাধা বা ব্লক তৈরি হতে থাকে। ফলে হৃদপিণ্ডের মাংসপেশি প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। ক্রমে এই ঘাটতি থেকে মাংসপেশি দুর্বল হতে থাকে। এক পর্যায়ে হার্ট সারা শরীরের রক্ত সরবরাহের চাহিদা পুরোটা মেটাতে ব্যর্থ হ্য় । হার্টের এই ব্যর্থতাকেই আমরা হার্ট ফেইলিওর বলি। তবে কোনো কারণে হৃদপিণ্ডের রক্তনালী অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে গেলে হার্ট ফেইল্যুরও অকস্মাৎ প্রকট আকার ধারণ করতে পারে, যেটাকে আমরা একিউট হার্ট ফেইলিওর (Acute heart failure) বলে থাকি। একিউট হার্ট ফেইলিওর এর প্রধানতম কারণ হলো একিউট হার্ট এটাক। মস্তিস্ক সহ সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অক্সিজেন ও খাদ্যের অভাবে দুর্বল হতে থাকে। রোগী স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে না। অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে, শ্বাসকষ্ট হয়, খাবার অরুচি হয়, পায়ে পানি আসে, পেট ফুলে যায়, এমনকি ফুসফুসেও পানি জমে তীব্র শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করতে পারে।

হার্ট ফেইলিওর এর চিকিৎসী কী :

ক) হঠাৎ হার্ট ফেইলিওরঃ

হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বা বুকে তীব্র ব্যথা হয়ে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে বুঝতে হবে হার্টে বা ফুসফুসে গুরুতর কোন সমস্যা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ঘরে বসে না থেকে দ্রুত কাছাকাছি কোন হাসপাতালে যেতে হবে। তবে হাসপাতালে পৌঁছাবার আগেই কিছু ওষুধপত্র প্রয়োগ করা যেতে পারে। যেমন- বুকে ব্যথা হলে ৩০০ মিলিগ্রাম এসপিরিন চিবিয়ে বা পানিতে গুলে খেতে পারেন। ক্লোপিডোগ্রেল বড়ি ৭৫ মিলিগ্রামের ৪ টি ( Replet, Pladex, Anclog, Odrel, Noclog, Clopilet ইত্যাদি নামে বাজারে মিলবে), একটি ৪০ মিলিগ্রামের এটরভাস্টাটিন ( Atova, Xelpid, Stacor, Lipicon, Anzitor, Tigilow ইত্যাদি ), একটি ৪০ মিলিগ্রামের গ্যাসের বড়ি; এবং শ্বাসকষ্ট শুরু হলে injection Lasix/Fusid ২ এম্মুল শিরাপথে প্রবেশ করিয়ে দ্রুত হাসপাতালে চলে যান।

হাসপাতালে পৌঁছে অক্সিজেন দিতে দিতে একটি ইসিজি করুন।

ইসিজি দেখেই ডাক্তার বুঝতে পারবেন যে, রোগীর হার্ট এটাক হলো কিনা। যদি তাই হয় তাহলে দ্রুত এনজিওগ্রাম করে হার্ট ব্লক খুলে দেবার ব্যবস্থা নিন।

খ) ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদী হার্ট ফেইলিওরঃ

দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা হার্ট ফেইলিওর চিকিৎসায় এখন অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, বিশেষ করে নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কারের ফলে রোগভোগ কমে গেছে, মৃত্যুহার কমে গেছে অনেকখানি।
ক্রনিক হার্ট ফেইলিওর চিকিৎসার প্রধান ৪ টি স্তম্ভ হলো-

১। বিটা ব্লকার ওষুধ যেমন- Carvedilol, metoprolol , bisoprolol নিয়মিত ব্যবহার করা।

২। রাসব্লকার ( RAAS Bloceker) বা ARNI ( যেমন Ramipril, Lisinopril, Perindopril , Losartan, olmesartan, telmisartan, valsartan এবং সর্বশেষ ম্যাজিক পিল ARNI যেমন Entresto, Vivanta, Sabitar, Arnigen ইত্যাদি) নিয়মিত ব্যবহার করা।

৩। MRA blocker : Spironolactone, Epleronon যেমন spirocard, epleron, inospiron ইত্যাদি নিয়মিত ব্যবহার করা।

৪। SGLTi যেমন Jardian, Evania, Emfogen, Empa ইত্যাদি নিয়মিত ব্যবহার করা। হার্ট ফেইলিওর চিকিৎসায় এই গ্রুপের ওষুধগুলো এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করছে। যদিও এই ওষুধটি প্রথমে ডায়াবেটিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় এটি হার্ট ফেইল্যুর এর চিকিৎসায় অত্যন্ত সুফল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। যাঁদের ডায়াবেটিস নেই তাঁরাও এটি সমানভাবে ব্যবহার করতে পারবেন।

উপরে উল্লেখিত এই চার ধরণের ওষুধকে বলা হয় গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড চারটি স্তম্ভ। কোনো রোগীই এই চারটি ওষুধ থেকে বঞ্চিত হওয়া উচিত নয়।

চূড়ান্ত হার্ট ফেইলিওর এর চিকিৎসাঃ

যখন উপরোক্ত চিকিৎসা সত্বেও রোগী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে না সেসব রোগীর জন্য আরো কিছু ব্যয়বহুল চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। যেমন-

১। AICD যা একধরণের শক দেবার পেসমেকার সদৃশ মেশিন যেটা বুকের কণ্ঠাস্থির নীচে সামান্য কেটে চামড়ার নীচে বসিয়ে দেয়া হয়। এটি রোগীকে খারাপ ধরণের এরিদমিযা জনিত হঠাৎ মৃত্যু থেকে শক দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে।

২। CRT-D যা AICD সদৃশ্য পেসমেকার এর মত একটি মেশিন যা একইভাবে চামড়ার নীচে বসিয়ে দেয়া হয়। এটি হার্টের সমন্বয়হীন সংকোচন প্রসারনকে সমন্বিত করে পাম্পিং ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। বলা বাহুল্য এটিও একটি ব্যয়বহুল মেশিন।

৩। LVAD যা হার্টের ভেতরে ছোট একটি অপারেশন করে বসিয়ে দেয়া হয়। সাধারণত হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট এর জন্য অপেক্ষমান রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।

উপরোক্ত চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীর লাইফ স্টাইল বিজ্ঞানভিত্তিক করাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ ।

নিয়মিত ৩০ মিনিট হাঁটা, ধূমপান সহ তামাকজাত দ্রব্য বর্জন করা, দৈনিক পানীয় তরল ১০০০-১২০০ মিলি রাখা, উত্তেজনাকে পরিহার করা, নিয়মিত ৬ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ ।

এছাড়া হার্ট এটাক এবং ফেইলিওর এর যে মূল কারণ অর্থাৎ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল ইত্যাদি অবশ্য অবশ্যই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

হার্ট ফেইলিওর প্রতিরোধ করুন, সুস্থ থাকুন।

এপ্রিল, ২০২৩।


আরও দেখুন: