রোগ নিয়ন্ত্রণ ও সুস্থতায় রোজার প্রভাব
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও সুস্থতায় রোজার প্রভাব- বিষয়ে লিখেছেন প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ
পবিত্র রমজান মাস ঘনিয়ে এসেছে। মহান আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য এই মাসজুড়ে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। তবে, রোজার মাস এলেই অনেকের মনে প্রশ্ন আসে, অসুস্থতা নিয়ে কিভাবে রোজা রাখবেন?
একটা কথা মনে রাখবেন, রোজা আল্লাহর হুকুম। এটি পালনের উদ্দেশ্য হলো: আত্মশুদ্ধি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত উন্নতি সাধন। রোজা রাখলে অনেকে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় করেন। কিন্তু রোজা রেখে ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে কারও মৃত্যু হয়েছে এমন কোনো ঘটনা শোনা যায়নি। বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণাতেও দেখা গেছে, রোজা রাখলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বেড়ে যায়।
কিছু কিছু অসুস্থ ব্যক্তি দুর্বলতা এবং নানারকম দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনার কারণে রোজা রাখতে গড়িমসি করেন। আসল কথা হলো- রোজা রাখলে শরীরের কোন ক্ষতি হয় না। এটা কেবলই মনের ভয়। কারণ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সুচিন্তিত অভিমত হলো, রোজা স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি তো করেই না বরং শরীর ও মনের উন্নতি ঘটে।
অতি অসুস্থ ও অতি বার্ধক্য থাকলে তার জন্য রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। পরে যদি স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে, তাহলে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী কাজা আদায় করতে হবে। আর রোজা রাখলে প্রাণহানীর আশঙ্কা আছে কি-না, এ বিষয়টি অবশ্যই কোনো আলেম এবং ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে।
গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে গর্ভবতী মায়েদেরকে রমজানের রোজা না রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা।
এছাড়াও যেসব মায়েরা সন্তানকে বুকের দুধ পান করান, তার নিজের বা তার স্তন্যপানকারী শিশুর ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে তাকেও রোজা না রাখার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য রোজা অত্যন্ত উপকারী। কারণ, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তাই নিয়ম মেনে রোজা রাখলে ডায়াবেটিস রোগীরা সুফল পেতে পারেন। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সুনিদিষ্ট গাইডলাইন অনুসরণ করতে হবে রোগীকে।
পেপটিক আলসারের রোগীরা ভয়ে অনেকেই রোজা রাখেন না। অথচ, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বলেন, পেপটিক আলসারের রোগীদের জন্য কম খাওয়া তথা রোজা বিশেষ উপকারী। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখলে পেটের দূষিত ক্ষতিকর পদার্থ বের হয়ে যায়। পাকস্থলীতে থাকা উপকারী জীবাণু খাদ্য হজমে সাহায্য করে। বছরের ১১ মাস এসব জীবাণু অনবরত খাদ্য হজমে ব্যস্ত থাকায় দুর্বল হয়ে পড়ে। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখলে জীবাণুগুলো বিশ্রাম পায়। ফলে এরা শক্তিশালী হয়ে উঠে। ফলে বাকি ১১ মাস আবার খাদ্য হজমে ভালোভাবে সাহায্য করতে পারে।
চর্বি ও কোলেস্টেরল অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার ফলে আমাদের দেহে হৃদরোগ, রক্তচাপ, বহুমূত্র রোগসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। রোজা রাখলে চর্বি বা কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমে যায়। ফলে শরীরকে বিভিন্ন রোগ থেকে নিরাপদ রাখে।
রোজা রাখলে মস্তিষ্কের অনেক উপকার হয়। সারাবছর অধিক খাদ্য গ্রহণে শরীরের ওপর যেমন চাপ বৃদ্ধি পায় তেমনি এই চাপ মস্তিষ্কের ওপরও পড়ে।
রোজা রাখলে কিডনি ও লিভার বিশ্রাম নিতে পারে। কিডনির মাধ্যমে শরীরে প্রতি মিনিটে ১ থেকে ৩ লিটার রক্ত সঞ্চালিত হয়। অপ্রয়োজনীয় পদার্থগুলো প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে যায়। সুস্থ রোগীর লিভার আরও সুষ্ঠুভাবে কার্যক্ষম হয়। তবে লিভারে বা কিডনিতে আক্রান্ত রোগীরা রোজা রাখার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। ধর্মীয় জ্ঞান সম্পন্ন চিকিৎসকের পরামর্শমাফিক রোজা রাখবেন কিংবা ছেড়ে দেবেন তারা।
যারা ধূমপান ও নেশাজাতীয় দ্রব্যে আসক্ত, এগুলো থেকে বের হয়ে আসার জন্য রোজার মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে অনেক রোগ যেমন- ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ বহু জটিল রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে।
আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, রোগ নিরাময়ের যতগুলো প্রতিকার এবং প্রতিষেধক রয়েছে- রোজা তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও ফলপ্রসূ। এ জন্যই রমজান মাসে হাসপাতাল ও চেম্বারে রোগীর উপস্থিতি অনেক কম হয়। সব মিলিয়ে রোজা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তো নয়ই বরং খুবই উপকারী।
দীর্ঘ জীবনে দেখেছি, অনেকে অসুস্থ অবস্থাতেও রোজা রাখতে চান। জানতে চান, কিভাবে রোজা রাখতে পারবেন। আবার অনেকেই নিজের মতো অজুহাত তৈরি করে রোজা না রাখার যুক্তি খোঁজেন। আসলে চিকিৎসকের পরামর্শ ও নিয়ম মেনে দীর্ঘস্থায়ী রোগেও রোজা রাখা সম্ভব।
এটা ঠিক যে, রোজা কষ্টকর ইবাদত। ক্ষুধা-পিপাসার কষ্টে কেউ কেউ রোজা ছেড়ে দেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া রোজা না রাখা গোনাহের কাজ। এ কারণে সুস্থদের তো বটেই, অনেক অসুস্থ ব্যক্তিরও রোজা ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক