ডেঙ্গু আতঙ্ক
ডা: সাদিয়া ইসলাম, এম.বি.বি.এস (ডিইউ), ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতাল।
'ডেঙ্গু'- বর্তমান সময়ের অত্যন্ত আলোচিত একটি রোগের নাম। এই রোগে প্রতিদিনই ছোট-বড় অনেক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এমনকি মৃত্যুবরণও করছে। পূর্বে কেবল বর্ষার মৌসুমে এটি বেশি দেখা গেলেও, এখন তা আর সেই সময়সীমাতে আটকে নেই। বরং এখনও সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। গেল বছরে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪০,০০০ ছাড়িয়েছে।
চলুন, দেরী না করে জেনে নেয়া যাক- ডেঙ্গুরোগ সম্পর্কে।
ডেঙ্গু কি?
ডেঙ্গু হলো একটি ভাইরাসজনিত ( Flavi virus) মশাবাহিত ( Aedes aegypti, Aedes albopictus) রোগ। স্ত্রী এডিস মশার কামড়ে মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়।
ধরন :
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ বা ধরন রয়েছে। সেগুলো হলো - DENV-1, DENV-2, DENV-3, DENV-4 (WHO).
উপসর্গ :
• জ্বর- তাপমাত্রা (৯৯°-১০৬°ফা) কমে আবার বাড়ে, তবে ১ম ৩-৪ দিন বেশি থাকে, তারপর জ্বর কমতে থাকে।
• মাথা ব্যথা, চোখের পেছনের দিকে ব্যথা।
• সারা শরীরে ব্যথা ও ছোট ছোট দানার মত সৃষ্টি হওয়া।
• বমি ভাব বা বমি হওয়া।
এছাড়াও রক্তক্ষরণের বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যেমন-
* দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়া
* নাক দিয়ে রক্ত কিংবা কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া
* গাঢ় বা লাল রঙের প্রস্রাব
* কালো রঙের পায়খানা
মহিলাদের ক্ষেত্রে, মাসিকের পথ দিয়ে রক্ত যাওয়া বা রক্তের প্রবাহ অন্যান্য বারের তুলনায় বেশি হওয়া।
জটিলতা :
ডেঙ্গুতে রক্তের অনুচক্রিকা (প্লাটিলেট- Platelet) সাধারণ মাত্রার (১,৫০০০০-৪,৫০০০০/কিউ.মি.মি) চেয়ে বেশি কমে গেলে এবং হেমাটোক্রিট (HCT) অনেক বেড়ে গেলে (>২০%) অর্থাৎ, প্লাজমা লিকেজ ঘটলে নানা ধরনের জটিলতা যেমন- ফুসফুসে পানি (প্ল্যুরাল ইফিউশন), পেটে পানি আসা (অ্যাসাইটিস), লিভার বড় হয়ে যাওয়া (হেপাটোমেগালি), হৃৎপিণ্ড সহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা সমূহ :
- CBC (Complete Blood Count) : এটির মাধ্যমে রক্তের প্লাটিলেট, হেমাটোক্রিট সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়।
- Dengue NS1 Antigen : এটি পজিটিভ হলে, রোগীর ডেঙ্গু নিশ্চিত। তবে, এই পরীক্ষাটি অবশ্যই জ্বরের প্রথম ৩দিনের মধ্যে করতে হবে। তা নাহলে সঠিক ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
- Dengue IgG, IgM : জ্বরের ৫ম-৭তম দিনের মধ্যে এই পরীক্ষাটি করা হলে ডেঙ্গুজ্বর নির্ণয় করা যায়। তবে IgM অ্যান্টিবডি বর্তমান ইনফেকশন ইঙ্গিত করে। আর IgG অনেক দিন পর্যন্ত পজিটিভ থাকে।
- SGPT, SGOT : লিভারে সমস্যা দেখা দিলে এগুলো বেড়ে যায়।
- অন্যান্য: এছাড়াও প্রয়োজন অনুসারে RBS, S.Electrolytes, Liver Function Test, , Renal Function Test, Urine R/M/E, Ultrasonogram of Whole Abdomen, Chest X-ray, ECG ইত্যাদি পরীক্ষাসমূহ করা হয়।
যা করণীয় :
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগের লক্ষণ, জটিলতা ও চিকিৎসা অনুযায়ী গ্রুপ এ, বি, সি এই তিনটি গ্রুপ বা দলে ভাগ করা হয়েছে।
'এ' গ্রুপের রোগীদের সাধারণত হাসপাতালে নেয়ার খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। রোগ নির্ণয়ের শুরু থেকেই ঘরেই বেশি করে তরল জাতীয় যেমন- ওরস্যালাইন, বিশুদ্ধ পানি, ডাবের পানি, ফলের রস, স্যুপ এগুলো খেতে হবে। পাশাপাশি স্বাভাবিক খাবার চলবে। জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল (দৈনিক ৪ গ্রামের বেশি নয়, এর বেশি হলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে)। বমি ভাব বা বমি হলে সেটির ওষুধ খাবে।
ব্লাড প্রেশার, পাল্স, তাপমাত্রা আর প্রস্রাব কতটুকু হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং মশারী ব্যবহার করবে।
'বি' গ্রুপের রোগীদের ক্ষেত্রে ঘরোয়া চিকিৎসাই যথেষ্ট নয়, বরং হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কেননা, এক্ষেত্রে রোগীদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা যেমন : মাত্রাতিরিক্ত জ্বর, অতিরিক্ত বমি, পেটে ব্যথা, ক্ষুধামন্দা ও রক্তক্ষরণ দেখা দেয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিরায় স্যালাইন (0.9% Nacl, Ringer lactate) দেয়ার পাশাপাশি মুখেও তরল জাতীয় খেতে উৎসাহিত করতে হবে। আর লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা তো চলবেই। এছাড়া প্রতিদিন রক্তের পরীক্ষায় প্লাটিলেট ও হেমাটোক্রিট বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
'সি' গ্রুপের রোগীদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তির পাশাপাশি আইসিইউ তেও নেয়ার প্রয়োজন হয়ে যায়, কেননা এই গ্রুপের রোগীদের ব্লাড প্রেশার একদম কমে যায়, পাল্স ঠিকমত পাওয়া যায় না, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় এমন কি লিভার - কিডনির পাশাপাশি হৃৎপিণ্ড এবং মস্তিষ্ক ও আক্রান্ত হতে পারে।
এ অবস্থায় রোগীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি রক্তদানেরও (Whole Blood, Platelet) প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী।
যা করণীয় নয় :
× ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে কোনো ভাবেই প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া যাবে না।
× অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রফেন, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন করা যাবে না।
× মাংসপেশীতে কোনো ধরনের ইনজেকশন দিবে না।
× দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়লে দাঁত ব্রাশের ব্যবহার পরিহার করা, তবে মাউথওয়াশ দিয়ে মুখ পরিষ্কার রাখতে হবে।
প্রতিরোধ :
ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধ করতে হলে সর্বপ্রথম এডিস মশা চেনা (কালোর মধ্যে সাদা ছোপ ছোপ) ও এটির বংশবিস্তার রোধ করতে হবে।
আশেপাশে ফুলের টবে, ভাঙা নারকেলের খোলসে কিংবা অব্যবহৃত টায়ারে জমে থাকা পানি বা পরিত্যক্ত ডোবা-নালা এগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে কেরোসিন, ডায়ালড্রিন ছিটিয়ে দিতে হবে।
মশারী ব্যবহার করতে হবে; বিশেষ করে ভোর বেলায়, এমনকি সন্ধ্যার দিকেও এডিস মশা বেশি সক্রিয় থাকে। মশা রোধে স্প্রে বা রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
পরিশেষে একটি কথাই বলবো, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়।
তাই ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্ক নয়, বরং এ ব্যাপারে সকলকে সচেতন হতে হবে।
লেখক :
ডা: সাদিয়া ইসলাম
এম.বি.বি.এস (ডিইউ)
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতাল।