সন্তানের জীবন বাঁচাতে ১০ করণীয়
১৬ বছরে এক কিশোর, ঠোঁটের ওপর গোফ উঁকি দিচ্ছে মাত্র। প্রচণ্ড বুকব্যথা নিয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে উপস্থিত
আজকের কথা। ১৬ বছরে এক কিশোর, ঠোঁটের ওপর গোফ উঁকি দিচ্ছে মাত্র। প্রচণ্ড বুকব্যথা নিয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে উপস্থিত। চিকিৎসক তার অবস্থা দেখে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে ভর্তি করেন।
সন্দেহের তীর হৃদরোগের দিকে। ইসিজি করে দেখা গেল, ল্যাটারেল লিডগুলোতে এস-টি ইলিভেটেড হয়ে আছে। মাত্র ১৬ বছরের কিশোরের এই অবস্থা! রক্তের কার্ডিয়াক ট্রোপোনিন আই এবং ক্রিয়েটিন কাইনেজ (মায়োকার্ডিয়াল ব্যান্ড) পরীক্ষা করে দেখা গেল, দুটিরই পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাৎ ছেলেটির হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।
মাত্র ১৬ বছরের কিশোর হৃদরোগে আক্রান্ত! কী মারাত্মক! এই ছেলেটি আপনার হতে পারত, আমার হতে পারত। এই ছেলেটি বড় হয়ে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, প্ল্যানার বা বিজ্ঞানী হতে পারত। হতে পারত দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা কেউ।
হৃদরোগের এই মারাত্মক প্রাদুর্ভাব আজ মহামারীর মতো দেখা যাচ্ছে। অল্প বয়সের মানুষও এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। গত তিন সপ্তাহের মধ্যে আমার খুবই অন্তরঙ্গ দুজন স্বাস্থ্য প্রশাসক ডা. মাহবুবুর রহমান এবং ডা. দেবাশীষ দেবনাথ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অল্প সময়ের মধ্যে মারা গেছেন।
আপনার সন্তান শুধু আপনার নয়। এরা দেশের সম্পদ। আপনি আপনার সন্তানের জীবন বাঁচান। সামান্য কয়েকটি টিপস দেই। নিজের মঙ্গলের জন্য এগুলো মেনে চলুন—
> আপনার ছেলেকে তার শৈশবকাল থেকেই ধুমপান এবং মদ্যপান না করার শিক্ষা দিন। তার মধ্যে ধুমপান, মদ ও মাদকবিরোধী মনোভাবের বীজ বুনে দিন।
> আপনার সন্তানকে দীর্ঘক্ষণ শুয়ে বা বসে থাকতে দিবেন না। এদের হাঁটতে বা খেলতে পাঠান। কোনো কাজ না পেলে বাজার করতে পাঠান। লক্ষ্য রাখবেন, সে সন্তান যেন গাড়িতে বা রিকশায় না চড়ে। অলস বসে থাকলে, দীর্ঘক্ষণ টিভি দেখলে, গেমস/খেলা দেখলে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যায়। একে আমরা Hypercoagulable state বলি । রক্তের ঘনত্ব বাড়লে রক্তের জমাট বাঁধার প্রবণতা বাড়ে। রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা যার বেশি, তিনি দ্রুত হৃদরোগে আক্রান্ত হন।
> চিনি (মিষ্টি), চর্বি ও লবণ যেখানে আছে, সে ধরনের খাবারগুলো পরিহার করতে বলুন। বাজারের কেক, পেস্ট্রি, আইসক্রিম, আলুর চিপস খেতে দিবেন না।
> প্রতিদিন কমপক্ষে আধ-ঘণ্টা জোরসে হাঁটতে বা দৌড়াতে দিন, যেন শরীরে ঘাম ছুটে (দৌড়াতে না চাইলে পেছনে কুকুর লেলিয়ে দিন, সে কথা বলছি না)।
> প্রতিদিন তিন বেলা শাক-সবজি খাওয়ান। এতে রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ক্যান্সার প্রতিরোধ হবে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হবে।
> আপনার সন্তানকে প্রতিযোগিতা থেকে দূরে রাখুন। প্রতিযোগিতা উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তা বাড়ায়। মনের শান্তি নষ্ট করে।
> তাকে দুশ্চিন্তা এবং উদ্বিগ্নমুক্ত থাকার শিক্ষা দিন। কারণ দুশ্চিন্তা এবং উদ্বিগ্নতা রক্তের কোর্টিসলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। বাড়তি কোর্টিসল হৃদরোগকে ত্বরান্বিত করে।
> আপনার সন্তানের ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন। শরীরের বাড়তি ওজন হাই ব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিস, হাঁটুতে এবং কোমরে স্থায়ী ব্যথা এবং Gastro-Esophageal Reflux Disorder রোগকে ডেকে আনে।
> আপনার সন্তানকে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর এবং সূর্য উঠার আগে ঘুম থেকে জেগে উঠার শিক্ষা দিন। যারা রাতে দেরি করে ঘুমায়, রাত জাগে এবং বিলম্বে ঘুম থেকে উঠে, তাদের হাই ব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
> আপনার সন্তানকে অল্পে তুষ্টি শিক্ষা দিন। যে অল্পে তুষ্ট হয় না, সে বেশি পেলেও তুষ্ট হয় না। যে তুষ্ট হয় না, তার হৃদয়ে হাহাকার বেশি। যে হৃদয়ে হাহাকার বেশি, সে হৃদয় শান্তি পায় না। যে হৃদয় শান্তি পায় না, সে হৃদয় অল্পতেই ভেঙে পড়ে।
অসুখে আক্রান্ত হয়ে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে চিকিৎসা করানোর চেয়ে রোগ প্রতিরোধ করাই উত্তম এবং সহজতর।
লেখক: ডা. মো. জয়নাল আবেদীন টিটো
বিভাগীয় প্রধান
জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান