শীতে ত্বকের যত রোগ, বাঁচতে করণীয়

ডা. আসমা তাসনিম খান
2021-12-10 19:20:16
শীতে ত্বকের যত রোগ, বাঁচতে করণীয়

ডা. আসমা তাসনিম খান

সাধারণত শীতকালে ত্বকের ওপর একটা প্রভাব পড়ে। শীতে আমাদের ত্বককে তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। এসময় তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা দুটোই কমতে থাকে। পাশাপাশি বাইরের ধুলাবালিও অনেক বাড়ে। এসব কিছু আমাদের শরীরে খারাপ প্রভাব ফেলে।

শীতে বাতাসে জলীয়বাষ্প কমে যাওয়ায় ত্বক থেকে পানি শুষে নেয় যার প্রভাবে আমাদের ত্বক শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে যায়।

আমাদের ত্বকের ওপরের স্তরটা হলো ‘এপিডার্মিস’। এই এপিডার্মিসের মধ্যে ৩০ ভাগ পানি থাকে। কিন্তু শীতে এই পানির পরিমাণটা ১০ ভাগে নেমে আসে এবং ত্বক হয়ে যায় শুষ্ক। ন্যাচারাল ময়েশ্চারাইজিং ফ্যাক্টর নামে একটা ব্যাপার আছে। শীতের মধ্যে এটার ওপরও একটা প্রভাব পড়ে।

শুধু কি শীতেই ত্বক শুষ্ক হয়? ব্যাপারটা কি এ রকম? আসলে কিন্তু না। গ্রীষ্মকালেও অনেক ক্ষেত্রে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা এবং আদ্রতা দুটোই বাড়ে, সঙ্গে রোদে বের হওয়ার পরিমাণটাও অনেকের ক্ষেত্রে অনেক বাড়ে। এসময় এসিতে অনেক সময় ধরে থাকাটাও কিন্তু ত্বক শুষ্কের পরিমাণটা অনেক বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া গরমে আমরা লম্বা একটা সময় ধরে গোসল করি বা সুইমিংপুলে যাচ্ছি এবং সেখানে অনেক সময় পার করছি। এটাও কিন্তু ত্বকের খারাপ প্রভাব ফেলছে। ক্যাফেইন, অ্যালকোহল বা পানি কম খাওয়া ছাড়াও আরও অনেক কারণ শীতের চেয়েও গরমে ত্বক শুষ্ক হয়।

অনেকে চিকিৎসকের কাছে কাছে জানতে চায়, শীতে তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে কি ত্বক শুষ্ক ও রুক্ষ হয় না কি রোগজনিত কোনো কারণ আছে? এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু রোগ আছে। যেমন আমরা বলি, অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস। একে একজিমাও বলা হয়। একটি একটি সাধারণ চর্মরোগ যার উপসর্গ হলো- চুলকানি ও আঁশের মতো ত্বক। এটি শিশু থেকে শুরু করে বয়স্কদের মধ্যেও দেখা যায়।

সোরিয়াসিসের কারণেও শীতে ত্বকে খারাপ প্রভাব দেখা যায়। এ সময় বিভিন্ন ধরনের একজিমাও বেড়ে যায়। তাছাড়া ফাঙ্গাল ইনফেকশনটাও বেড়ে যায়। আমরা জানি, ফাঙ্গাল ইনফেকশন এমন রোগ যা ঘামের বা ফাঙ্গাসের জন্য হচ্ছে। কিন্তু শীতকালে কয়েকটা স্তরের কাপড় পরি। বিশেষ করে বাচ্চারা ডায়পার পরছে আবার দুই-তিন স্তরের কাপড় পরছে। ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে ঘাম জমে যায়। সেই ঘামটা ঠিকভাবে পরিষ্কার না করার ফলে ফাঙ্গাল ইনফেকশনটা খুব দেখা দেয়। আর বাচ্চাদের চামড়া বেশি পাতলা থাকে যার কারণে গাল লাল হয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের র‌্যাস হয়ে যাচ্ছে, চামড়ার মতো উঠছে এবং ফেটে ফেটে যাচ্ছে। ঠোঁটের ক্ষেত্রেও ঠিক এরকমই। ঠোঁটের চামড়া অনেক বেশি পাতলা হওয়ায় ফেটে যায় অনেক বেশি।

ছোটদের ক্ষেত্রে কোল্ড অ্যালার্জি বেশি দেখা যায়। বড়দের ক্ষেত্রে মাইট অ্যালার্জি, ডাস্ট অ্যালার্জি- এ ধরনের সমস্যাগুলো বেশি দেখতে পাই।

সমাধান

শীতে আপনি যে পানি ব্যবহার করবেন, সেটা বেশি গরম বা ঠান্ডা হওয়া যাবে না। আমরা বলি, উষ্ণ গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। কারণ বেশি গরম পানি ব্যবহার করলে দেখা যাবে আমাদের শরীরে যে তেল উৎপাদন হয় সেটা বেরিয়ে যাবে এবং আমাদের ত্বক শুষ্ক হয়ে যাবে।

খুব অল্প সময় নিয়ে গোসল করতে হবে। সেটা পাঁচ থেকে ১০ মিনিট হতে পারে। শীতে বারবার পানি দিয়ে মুখ ধোয়াটাও উচিত নয়। এক্ষেত্রেও দেহে যে তেল উৎপাদন হয় সেটা বেরিয়ে যাবে।

অনেকের শীতের মধ্যে ব্রণের প্রভাবটা অনেক বেড়ে যায়। তাদের ক্ষেত্রে এ সময় স্যালিসাইলিক অ্যাসিড কিংবা গ্লাইকোলিক অ্যাসিড বা ফেসওয়াশ ব্যবহার করছেন, সেটা যতটা সম্ভাব কম ব্যবহার করতে হবে। অন্যথায় ত্বক কিন্তু আরও শুষ্ক হয়ে যাবে।

গোসল করে বের হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাদের উচিত হবে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা। কারণ, আপনি গোসলের সময় আপনার দেহে যে পানি নিয়ে এসেছেন, সেটা বের হওয়া থেকে বন্ধ করতে হবে। দিনে-রাতে মিলিয়ে দুইবার (গোসলের পরে এবং রাতে ঘুমতে যাওয়ার আগে) ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে।

সাধরণত শীত আসলেই আমরা বিভিন্ন ধরনের সুপারশপে চলে যাই বিভিন্ন ধরনের ক্রিম, কোল্ড ক্রিম, ময়েশ্চারাইজার, লোশন কেনার জন্য। অবশ্যই এগুলো কেনার সময় খেয়াল রাখতে হবে গ্লিসারিন, ভ্যাসলিন, প্যারাফিন, লিকুয়িড প্যারাফিন, শেয়ার বাটার বা কোকোয়া বাটার এগুলো আছে কি না। এগুলো দেখে লোশন বা ক্রিম পছন্দ করতে হবে। তবে আপনি যে প্রোডাক্টই ব্যবহার করেন না কেন, সেটা যেন ডার্মাটোলজিকালি অনুমদিত হয়। একই সঙ্গে রঙহীন বা গন্ধহীন হতে হবে। তাহলে এটি আপনার ত্বকের জন্য অ্যালার্জি তৈরি করবে না।

অনেকে প্রশ্ন করেন, অ্যালোভেরা জেল কি ব্যবহার করা যাবে? অ্যালোভেরা জেল বেইজড একটা ভালো পণ্য। কিন্তু শীতে এই জেল বেইজড পণ্য ব্যবহার করলে খুব তাড়াতাড়ি ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। সুতারং শীতে জেল বেইজড কোনো পণ্য ব্যবহার না করা ভালো।

সানব্লক

আমরা জেনে বা না জেনে কিন্তু শীতে একটু উষ্ণতা পাওয়ার জন্য হলেও রোদের মধ্যে গিয়ে বসছি। এজন্য কমপক্ষে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত তিনবার সানব্লক লাগানোর চেষ্টা করবেন। সানব্লক একবার লাগালে দুই থেকে তিন ঘণ্টা কাজ করে। এর পর তার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য বারবার সানব্লক লাগানোর চেষ্টা করতে হবে।

সানব্লকটি কেনার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে এটি কেমিক্যাল বা ফিজিকাল দুটি উপাদান একসঙ্গে আছে কি না। অন্যথায় ফিজিক্যাল সানব্লক যেটার মধ্যে জিংক-অক্সাইড বা টাইটানিয়াম ডাই-অক্সাইড আছে এ ধরনের পণ্যটি কিনতে হবে।

যাদের শীতে বেশি পা ফাটে, তাদের জন্য কমপক্ষে সপ্তাহে দুবার কুসুম গরম পানিতে পা ভিজিয়ে রাখুন। এরপর পায়ের মরা চামড়া ঘষে তুলে ফেলুন। এর পরেই একটা ক্রিম, ময়েশ্চারাইজার বা লোশন ব্যবহার করবেন।

যাদের বারবার হাত ধুতে হয়, তারা প্রত্যেকবার হাত ধোয়ার পরে একবার করে ক্রিম বা লোশন লাগিয়ে নেবেন।

খুব বেশি কষ্ট করতে হবে বিষয়টা ওই রকম নয়। আমরা তো প্রতিদিন আমাদের নিজেদের যত্ন নিই। সেই রুটিনে একটু পরিবর্তন নিয়ে আসলেই কিন্তু শীতের এই প্রভাব ত্বকের ওপর পড়বে না।

ডা. আসমা তাসনিম খান
সহকারী অধ্যাপক,
নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল (এনআইএমসিএইচ)
পরিচালক ও মেডিকেল কনসালটেন্ট,
ইডব্লিউ ভিলা মেডিকা


আরও দেখুন: