গ্যাস্ট্রিকের কারণ ও প্রতিকার

ডা. ইসমাইল আজহারি
2021-10-24 20:46:13
গ্যাস্ট্রিকের কারণ ও প্রতিকার

হাইড্রোক্লোরিক এসিড দিয়ে মিউকাস মেমব্রেনের যে প্রদাহ হয়, এই অবস্থাকে গ্যাস্ট্রাইটিস বা গ্যাস্ট্রিক রোগ বলে।

আমরা যখন কোনো খাবার গ্রহণ করি, তখন খাদ্য পরিপাকের জন্য এবং খাদ্যে উপস্থিত অণুজীবসমূহকে ধ্বংস করার জন্য পাকস্থলী থেকে হাইড্রোক্লোরিক এসিড নামক এক প্রকার এসিড ক্ষরিত হয়। এটি খাদ্য পরিপাকে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।

একজন সুস্থ মানুষের পাকস্থলীতে প্রতিদিন প্রায় দেড় থেকে দুই লিটার হাইড্রোক্লোরিক এসিড ক্ষরিত হয়। এই হাইড্রোক্লোরিক এসিড ক্ষরণের মাত্রা যদি কোনো কারণে বেড়ে যায়, তখন পেটের ভেতরের আবরণ তথা মিউকাস মেমব্রেনে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। হাইড্রোক্লোরিক এসিড দিয়ে মিউকাস মেমব্রেনের যে প্রদাহ হয়, এই অবস্থাকে গ্যাস্ট্রাইটিস বা গ্যাস্ট্রিক রোগ বলে।

গ্যাস্ট্রিক হওয়ার প্রক্রিয়া

আমরা জেনেছি, আমাদের পেট থেকে প্রতিনিয়ত হাইড্রোক্লোরিক এসিড ক্ষরিত হয়। তাই যখন পাকস্থলী খালি থাকে, তখন হাইড্রোক্লোরিক এসিডসমূহ ব্যবহৃত না হয়ে অধিক পরিমাণে জমা হয়ে যায়। কারণ, হাইড্রোক্লোরিক এসিডের কাজ হচ্ছে খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করা। কিন্তু যখন খালিপেট থাকে কিংবা যখন পেটে কোনো খাবারই থাকবে না, তখন অতিরিক্ত এসিড পাকস্থলীতে জমে যায়। অতিরিক্ত এসিডের কারণে তখন পাকস্থলীর ভেতর ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং পর্যায়ক্রমে তা অন্ত্রের দিকেও ছড়িয়ে পড়ে। আবার পাকস্থলির উপরের দিকে খাদ্যনালী তথা ইসোফেগাসের দিকেও ছড়িয়ে যেতে পারে।

এসিড যদি পাকস্থলির ওপরের দিকে খাদ্যনালী বা ইসোফেগাসকে আক্রান্ত করে, তবে এই অবস্থাকে গ্যাস্ট্রো ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ বলা হয়। এই ক্ষেত্রে আক্রান্ত রোগীদের বেশি বেশি ঢেকুর আসবে এবং রোগী তার বুক জ্বালাপোড়া করে বলে অভিযোগ করবে। সকালে ঘুম থেকে উঠলে গলাতে কফ জমে থাকতে পারে। বমিবমি ভাব থাকবে। বুকের মাঝখানে ব্যথা অনুভব হবে। খাবার রুচি চলে যাবে। প্রচুর পরিমাণ থুথু আসতে পারে।

প্রদাহের পরিমাণ বেশি বেড়ে পাকস্থলির মাঝে আলসার তৈরি করতে পারে, যাকে আমরা গ্যাস্ট্রিক আলসার বলে থাকি। আলসার হতে থাকলে সেখানে কোষসমূহের গাঠনিক পরিবর্তন আসতে পারে। এক প্রকারের কোষ অন্যপ্রকার কোষে রুপান্তরিত হতে পারে, যাকে মেটাপ্লাসিয়া বলা হয় এবং পরিশেষে তা থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।

গ্যাস্ট্রিকের উপসর্গ

১. পেটের বাম পাশে উপরিভাগে ব্যথা

২. বুক জ্বালাপোড়া

৩. খাবারে অরুচি

৪. পেট জ্বালাপোড়া

৫. পেট ফেঁপে থাকা

৬. মাথা ঘুরানো

৭. বমিবমি ভাব

৮. অল্প খাবারের পর পেট পূর্ণ হয়ে গেছে মনে হওয়া

৯. গ্যাস্ট্রো ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজের ক্ষেত্রে বুকে ব্যথা, সঙ্গে অধিক হারে ঢেকুর ও বমিভাব।

১০. ডিউডেনাম আলসার হলে পেটের মাঝামাঝি ব্যথা এবং ব্যথা পুরো পেটে ছড়িয়ে পড়া

১১. গ্যাস্ট্রিক আলসারের সবচেয়ে অসাধারণ উপসর্গ হচ্ছে খাবার চাহিদা বেড়ে যাওয়া। অধিকহারে খাবার পরেও রোগীর ক্ষিধা লাগবে। কারণ, আলসারের কারণে অনেক সময় দেখা যায়, পাকস্থলি থেকে ব্রেইনের হাঙ্গার সেন্টারে তথা ক্ষিধা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে নার্ভ সিগনাল সঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারে না। তাই রোগী পেট ভরে খেলেও ক্ষিধা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে সঠিক মেসেজ না পাওয়ার কারণে ক্ষিধার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

গ্যাস্ট্রিকের কারণ

১. অনিয়মিত খাবার খাওয়া

২. তেলে ভাজা খাবার কিংবা অধিকহারে তৈলাক্ত খাবার খাওয়া

৩. কোল্ড ড্রিংক খাওয়া

৪. ধূমপান করা

৬. পানি কম খাওয়া

৭. রাত্রে খাবার খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে যাওয়া (এই ক্ষেত্রে এসিড রিফ্লাক্স হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি)

৮. বেশি পরিমাণে গোশত খাওয়া

৯. ব্যথানাশক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে গ্যাস্ট্রিক ও গ্যাস্ট্রিক আলসার হতে পারে। তাই ব্যথানাশক ওষুধ খেলে সঙ্গে একটি অ্যান্টি-আলসারেন্ট ট্যাবলেট খেতে দেওয়া হয়।

১০. এইচ পাইলোরি নামক ব্যাকটেরিয়া দিয়ে সংক্রমিত হলে ডিউডেনাল আলসার হতে পারে

গ্যাস্ট্রিক প্রতিরোধে করণীয়

১. নিয়মিত সময়মাপিক খাবার খাওয়া

২ বেশি বেশি পানি পান করা, প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন লিটার পানি পান করা

৩. তৈলাক্ত খাবার ও চর্বি জাতীয় খাবার পরিহার করা। নিয়মিত শাক-সবজি ইত্যাদি খাওয়া

৪. অতিরিক্ত ঝাল খাবার পরিহার করা

৫. রাতের খাবার রাত ৯টার মধ্যে শেষ করা এবং খাবারের পর ২০-৩০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করা

৬. নিয়মিত সকাল বেলায় ইসবগুল ভিজিয়ে পানি পান করা। এতে করে অতিরিক্ত হাইড্রোক্লোরিক এসিড নিউট্রালাইজড হয়ে যাবে

৭. সকালে খালি পেটে ২ গ্লাস পানি পান করা

৮. দৈনিক কখনোই যেন ১৩০ গ্রামের বেশি গোশত খাওয়া না হয়

৯. অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকা

১০. ধূমপান, অ্যালকোহল ইত্যাদি পরিহার করা

১১. রাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানো। সর্বনিম্ন ৬-৭ ঘণ্টা ঘুমানো


আরও দেখুন: