আর্থ্রাইটিস রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
প্রতীকী ছবি।
আজ ১২ অক্টোবর বিশ্ব আর্থ্রাইটিস দিবস। সারা পৃথবীব্যাপী দিবসটি পালন করা হচ্ছে। দেশে সরকারিভাবে কোন উদ্যোগ না নেয়া হলেও বিভিন্ন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি আয়োজনের মাধ্যমে দিবসটি পালন করছে।
গ্রিক শব্দ 'আর্থো'-এর মানে হলো অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জোড়া এবং 'আইটিস' শব্দের মানে প্রদাহ। খুব সাধারণভাবে বলা যায়, আর্থ্রাইটিস হলো অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জোড়ার প্রদাহ। প্রতি বছর এই দিনটি বাত ব্যথা বা আর্থ্রাইটিস বিষয়ে সচেতনতার জন্য পালিত হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য 'বাত ব্যাথা নিয়ন্ত্রণের এখনই সময়'।
১৯৯৬ সাল থেকে বিশ্ব আর্থ্রাইটিস দিবসটি 'আর্থ্রাইটিস অ্যান্ড রিউমেটিজম ইন্টারন্যাশনাল'-এর তত্ত্বাবধানে উদযাপিত হয়। প্রাচীনকাল থেকে এই রোগটির অস্তিত্ব থাকলেও সাড়ে চার হাজার খ্রিস্টপূর্ব থেকেই এটি পুস্তক বা নথিভুক্ত হওয়া শুরু করে এবং আকারে সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়তে এবং সংক্রমিত হতে শুরু করে। ১৮৫৯ সালের দিকে রোগটিকে তার বর্তমান 'আর্থ্রাইটিস' নামকরণ করা হয়।
'আর্থ্রাইটিস ফাউন্ডেশন আটল্যান্টা'-এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে মানুষের অক্ষমতার প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো আর্থ্রাইটিস। বর্তমানে শুধু আমেরিকাতেই সাত মিলিয়নের বেশি লোক এখন আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত। আমাদের দেশে প্রায় পঁচিশ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধরণের বাত ও জটিল বাত রোগে আক্রান্ত।
আর্থ্রাইটিস কোন একক রোগ নয়; এটি অনেকগুলো রোগের প্রধান লক্ষণ। ২০১৩ ও ২০১৬ সালে আলাদাভাবে দুটি গবেষণা চালানো হয় যেখানে আর্থ্রাইটিসের ১০০ প্রকার উল্লেখ করা হয়। প্রদাহের কারণভেদে এ রোগটিকে সাধারণত অস্টিও আর্থ্রাইটিস, ইনফ্লামেটরি বা ওটোইম্যুন আর্থ্রাইটিস যার মধ্যে রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস, গাউট, সংক্রমণজনিত আর্থ্রাইটিস, জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি শ্রেণিভুক্ত করা হয়ে থাকে। পশ্চিমা বিশ্বে রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিসবেশি দেখা গেলেও আমাদের দেশে অস্টিওআর্থাইটিস এ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়, যা পুরুষদের চেয়ে নারীদের ক্ষেত্রে চারগুণ বেশি। সর্বোপরি ইনফ্লামেটরি বা ওটোইম্যুন আর্থ্রাইটিস নারীদের বেশি আক্রান্ত করে থাকে।
ইনফ্লামেটরি বা ওটোইম্যুন আর্থ্রাইটিসের প্রধান লক্ষণগুলো হলো অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যথা, জয়েন্ট ফুলে যাওয়া ও শক্ত হয়ে যাওয়া। এ ছাড়া এ রোগের অন্য উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাতঃকালীন জড়তা, চলাফেরায় জড়তা, মাংসপেশিতে ব্যথা, জয়েন্টের ফ্লেক্সিবিলিটি কমে যাওয়া। প্রকারভেদে ভিন্ন ভিন্ন আর্থ্রাইটিস বিভিন্ন জয়েন্টকে আক্রান্ত করে থাকে। রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস প্রধানত দুই হাত বা পায়ের ছোট ছোট পাঁচ বা তার অধিক জয়েন্টকে আক্রান্ত করে থাকে। এ ছাড়া যেসব সন্ধিতে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে, সেগুলো হল হাঁটু, কনুই, রিস্ট ও শোল্ডার জয়েন্ট। আর্থ্রাইটিসে চিকিৎসা না নিলে কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে জয়েন্ট ডিফরমিটি বা বিকৃতি হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিস নামক রোগে প্রধানত মেরুদণ্ডের জয়েন্টগুলো আক্রান্ত হয়। যা সাধারণত ৪৫ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত রোগীরা ইনফ্লামেটরি ব্যাক পেইন নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন। এই ব্যথা সাধারণত বিশ্রামে, ভোররাত বা সকালে বেশি থাকে এবং হাটাচলা বা কর্মকাণ্ডের ফলে উন্নতি হয়। এ ছাড়া এই আর্থ্রাইটিস পেটের প্রদাহ, এক বা দুই চোখ লাল হয়ে দেখতে অসুবিধা হতে পারে এটা সাধারণত ইউভাইটিস, লিগামেন্ট বা মাংসের টেন্ডন হাড়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে থাকে, সেখানেও প্রদাহ হতে পারে; যেটিকে এন্থেসাইটিস, চর্মের বা নকের সোরিয়াসিস রোগের ইতিহাস থেকে থাকে। যেসব সন্ধিতে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে সেগুলো হলো হাঁটু, হিপ, কোমর, ঘাড়, হাত ও পায়ের আঙুল, কনুই, রিস্ট প্রভৃতি।
অস্টিও আর্থ্রাইটিস আরেকটি খুব সাধারণ বাত। আমাদের জয়েন্টের ভেতরে হাড়ের শেষ প্রান্তে কার্টিলেজ নামক এক ধরণের অংশ থাকে, যা অস্থিসন্ধিকে ফ্লেক্সেবল রাখে এবং জয়েন্টের অতিরিক্ত চাপ বা প্রেসার শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। কোনো কারণে এ কার্টিলেজ নামক পদার্থটি যদি ক্ষয় হয়ে যায়, তখন তা আরথ্রাইটিসের রূপ নিতে থাকে। জয়েন্ট মার্জিনে নতুন হাড় তৈরি হয়। আর্থাইটিসের তীব্রতা ও ধরণের ইনজুরি ও ক্ষয় হওয়ার ওপর নির্ভর করে। সাধারণত যারা অধিক ভারী কাজ করে বা যাদের ওজন বেশি, তাদের ক্ষেত্রে জয়েন্টের ওপর চাপ বাড়তে থাকে এবং আর্থ্রাইটিস হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। বয়সের কারণেও আর্থ্রাইটিস হয়ে থাকে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জয়েন্টের ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে কার্টিলেজ ধীরে ধীরে ক্ষয় হয় এবং জয়েন্টের দুই দিকে হাড়ের ঘর্ষণে ব্যথা হয়। এই রোগে সাধারণত হাঁটু বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হয়। মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং জয়েন্ট নাড়াচাড়া করলে মুড়মুড় শব্দ করা, হাঁটু বাইরের দিকে বেঁকে যাওয়া এই রোগের অন্যতম উপসর্গ। জয়েন্টে ক্রমাগত আঘাত লাগা বা অপারেশন করা, জয়েন্ট ইনফেকশন হওয়া, বিভিন্ন জন্মগত ত্রুটি, রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণেও আর্থ্রাইটিস হয়ে থাকে।
আর্থ্রাইটিস হয়ে গেলে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। চিকিৎসক রোগের লক্ষণ, রোগীর ইতিহাস, পারিবারিক ইতিহাস, রোগীর প্রদাহের বিস্তারিত এবং শারীরিক পরীক্ষা এবং জয়েন্টের এক্স-রে, রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ শনাক্ত করেন। এ ক্ষেত্রে প্রধানত রিউম্যাটোলজিস্ট ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ও ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রামাণিত হয়েছে যে, যথাসময়ে রোগ নির্ণয় এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে আর্থ্রাইটিসের নিয়ত্রণ করা সহজ।
মনে রাখতে হবে, ব্যথার জন্য অযাচিত কিছু ব্যথানাশক ওষুধ বা স্টেরয়েড সেবন করলেও রোগীর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়ে থাকে। বেশির ভাগ আর্থ্রাইটিসের মূল চিকিৎসা হলো রোগ নিয়ন্ত্রণকারী অ্যান্টিরিউম্যাটিক ড্রাগ। এগুলো তৎক্ষণাৎ ব্যথা না কমালেও রোগকে নিয়ন্ত্রণ করে। এসব ওষুধ দীর্ঘদিন সেবন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি নিয়মিত পরীক্ষা করে তাদের কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা প্রয়োজন। রোগ নিয়ন্ত্রণকারী অ্যান্টিরিউম্যাটিক ড্রাগগুলো হলো মেথট্রেক্সেট, সালফাসালাজিন, লেফনুমামাইড, টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টর ইনহিবিটরস ও জেনাস কাইনেজ ইনহিউবিটরস।