ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসা ও উত্তর
ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আবুল ফয়সাল মোহাম্মদ নুরুদ্দীন চৌধুরী
দেশে প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। দিনদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সংক্রমণটি মোটেই অবহেলা করার মত নয়। কারণ, এটি গুরুতর পর্যায়ে চলে গেলে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে মানুষের মাঝে প্রবল উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ডক্টর টিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্য ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কিত গণমানুষের প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসার আলোকে উত্তর তৈরি করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আবুল ফয়সাল মোহাম্মদ নুরুদ্দীন চৌধুরী।
১. ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো কী?
সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। জ্বরের তাপমাত্রা ১০১ থেকে ১০২ ডিগ্রি থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেবার পর আবারও আসতে পারে। এর সাথে শরীর ব্যাথা, মাথাব্যাথা, চোখের পেছনে ব্যাথা ও চামড়ায় লালচে দাগ (Rash) হতে পারে। মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধিতে (Bone) যন্ত্রণা, বমি অথবা বমি বমি ভাব এবং পেট ব্যাথা থাকতে পারে। তবে এগুলো না থাকলেও ডেঙ্গু হতে পারে।
২. জ্বর হলেই কি চিন্তিত হবেন?
এখন যেহেতু ডেঙ্গুর সময়, তাই জ্বর হলে অবহেলা করা উচিত নয়। জ্বরে আক্রান্ত হলেই সাথে সাথে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশই জ্বরকে অবহেলা করেছেন। জ্বরের সাথে যদি সর্দিকাশি, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কিংবা এ জাতীয় কোন লক্ষণ থাকে, তাহলে সেটি ডেঙ্গু না হয়ে অন্য কিছু হতে পারে। তবে জ্বর হলেই সচেতন থাকতে হবে।
৩. বিশ্রামে থাকতে হবে:
জ্বর হলে বিশ্রামে থাকতে হবে। প্রতিদিন সাধারণত যেসব পরিশ্রমের কাজ করা হয়, সেগুলো না করাই ভালো। পরিপূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন।
৪. কী খাবেন?
প্রচুর পরিমাণে তরল বা তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন- ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের জুস ও খাবার স্যালাইন গ্রহণ করা যেতে পারে। এমন নয় যে প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে, পানি জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। সহজে হজম হয় না এমন খাবার ডেঙ্গু রোগীর খাওয়া উচিত নয়। যেমন- আমিষ খাবার, চর্বি, তৈলাক্ত খাবার, ভাজি ইত্যাদি।
৫. প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে?
ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। স্বাভাবিক ওজনের একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ চারটি প্যারাসিটামল খেতে পারবে। প্যারাসিটামলের সর্বোচ্চ ডোজ হচ্ছে ওজনভেদে প্রতিদিন তিন-চার গ্রাম। কিন্তু কোন ব্যক্তির যদি লিভার, হার্ট ও কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
৬. যেসব ওষুধ খাওয়া উচিত নয়:
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যাথার জন্য অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া বা কোন ব্যাথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না । ডেঙ্গুর সময় অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
৬. ডেঙ্গুর টেস্ট কখন করা উচিত?
জ্বর আসার পর টেস্ট (Dengue Test) করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রথমে ডেঙ্গুর NS1 Antigen test করতে হয়। জ্বর আসার দিন থেকেই এই টেস্ট করতে পারেন। সব জায়গাতেই এই পরীক্ষা করা সম্ভব। এই টেস্ট জ্বর আসার সর্বোচ্চ চার দিনের মধ্যে করতে হবে, এরপর করলে এটা নেগেটিভ আসতে পারে।
পরবর্তীতে IGM Dengue Antibody করতে পারেন। এই টেস্ট রোগীর শরীরে জ্বর আসার পাঁচদিন থেকে পজিটিভ আসতে পারে। জ্বর আসার পঞ্চম দিন থেকে IGM Dengue Antibody করতে হয়। এছাড়া কিছু জরুরি পরীক্ষা শুরু থেকেই করতে হয়। যেমন CBC ও SGPT, জ্বরের সাথে অন্যান্য লক্ষণ দেখা দিলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসক আরও কিছু পরীক্ষার পরামর্শ দিতে পারেন।
৭. প্ল্যাটিলেট বা রক্তকণিকা নিয়ে চিন্তিত?
ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে প্ল্যাটিলেট বা রক্তকণিকা এখন আর মূল ফ্যাক্টর নয়। তাই প্ল্যাটিলেট কাউন্ট নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কোন প্রয়োজন নেই। বিষয়টি চিকিৎসকের উপর ছেড়ে দেয়াই ভালো। চিকিৎসক প্ল্যাটিলেটের পাশাপাশি রক্তের আরও কিছু উপাদানও দেখেন। যেমন- WBC, HCT ইত্যাদি। সাধারণত একজন মানুষের রক্তে প্ল্যাটিলেট কাউন্ট থাকে দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ পর্যন্ত। প্লাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজারের নিচে নামলে বা শরীরের কোন জায়গা থেকে রক্তপাত হলে প্রয়োজনবোধে প্লাটিলেট বা ফ্রেশ রক্ত দেওয়া যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি খুবই কম দেখা যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেবেন।
৮. ডেঙ্গু হলেই কি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়?
ডেঙ্গু জ্বরের তিনটি ভাগ রয়েছে। ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’। প্রথম ক্যাটাগরির রোগীরা নরমাল থাকে। তাদের শুধু জ্বর থাকে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগীই ‘এ’ ক্যাটাগরির। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হবার কোন প্রয়োজন নেই।
‘বি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু রোগীদের সবই স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু শরীরে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন- পেটে ব্যাথা হতে পারে, প্রচুর বমি হতে পারে কিংবা সে কিছুই খেতে পারছে না। এদের হাসপাতালে নিতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, দু’দিন জ্বরের পর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই ভালো।
‘সি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু জ্বর সবচেয়ে মারাত্মক। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র বা আইসিইউর প্রয়োজন হতে পারে।
৯. ডেঙ্গু জ্বরের সময়কাল:
সাধারণত জুন থেকে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ থাকে। কারণ এ সময়টিতে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। তবে এবার দেখা যাচ্ছে সময়কাল আরও এগিয়ে এসেছে। এখন এপ্রিল মাস থেকেই ডেঙ্গু জ্বরের সময় শুরু হয়ে যাচ্ছে।
১০. এডিস মশা কখন কামড়ায়?
ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা অন্ধকারে কামড়ায় না। সাধারণত সকালের দিকে ও সন্ধ্যার কিছু আগে এডিস মশা তৎপর হয়ে ওঠে। এ সময় বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন।
১১. পানি জমিয়ে না রাখা:
এডিস মশা সাধারণত ডিম পাড়ে স্বচ্ছ পানিতে। তাই কোথাও তিন থেকে পাঁচদিনের বেশি পানি জমিয়ে রাখা উচিত নয়। মশার বংশবিস্তার রোধ করা, বাড়ির আঙিনা ও বারান্দা পরিষ্কার রাখা এবং ফুলের টব, টায়ার, এগুলোতে যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখা।