মাঙ্কিপক্সঃ ভীতি, বাস্তবতা এবং সতর্কতা
মাঙ্কিপক্স আক্রান্ত রোগী (ইনসেটে ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম)
জীবনে একবার চিকেনপক্স হয় নাই এমন মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে কম। শক্তিশালী ইমিউনিটি তৈরী হওয়ায় একবার চিকেনপক্স হলে দ্বিতীয়বার চিকেনপক্স হওয়ার সম্ভবনা অনেক কমে যায়।
মাঙ্কিপক্স বা এমপক্সের সাথে চিকেনপক্সের নামের মিল থাকলেও এই রোগ দুটি হয় দুটি ভিন্ন জাতের ভাইরাস সংক্রমণে। চিকেনপক্স হয় ভেরিসেলা জোস্টার ভাইরাসে। আর এমপক্স হয় মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের সংক্রমণে। তবে দুটি রোগই অত্যান্ত ছোঁয়াচে।
মাঙ্কিপক্স রোগের সাথে মূলত মিল রয়েছে স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের। স্মলপক্স ভাইরাস এবং মাঙ্কিপক্স ভাইরাস দুটোই অর্থোপক্সভাইরাস পরিবারে সদস্য। ভেরিওলা ভাইরাস সংক্রমণে হয় গুটিবসন্ত বা স্মলপক্স আর মাঙ্কিপক্স ভাইরাস সংক্রমণে হয় এমপক্স।
গুটিবসন্ত ছিলো ভয়াবহ মরণঘাতি রোগ। ভেরিওলা ভাইরাসের সবচেয়ে কমোন বা প্রচলিত ভ্যারিয়েন্ট ভেরিওলা মেজর ভাইরাস দিয়ে গুটিবসন্ত বা স্মলপক্স হলে তা থেকে মৃত্যু হার ছিল ৪০-৬৫ শতাংশ। আমাদের দেশের শেষ যে শিশুটির গুটিবসন্ত হয়েছিল সেও ভেরিওলা মেজর ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিল। পৃথিবী থেকে নির্মূলের আগ পর্যন্ত গোটা পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ মা/রা/ যায় এই স্মলপক্সে।
গণটিকার মাধ্যমে গুটিবসন্ত বা স্মলপক্স পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়েছে ১৯৭৭ সালে। বাংলাদেশে সর্বশেষ এই রোগটি দেখা দেয় ১৯৭৫ এ। ১৯৭৩ এর পূর্বে যাঁদের জন্ম তাঁরা সম্ভবত স্মলপক্সের ভ্যাক্সিন পেয়েছেন।
স্মলপক্সের ভ্যাক্সিন তৈরী করা হয়েছিল অর্থোপক্সভাইরাস পরিবারে আরেক সদস্য ভ্যাক্সিনিয়া ভাইরাসটিকে ব্যবহার করে। এ কারণেই স্মলপক্সের ভ্যাক্সিনে তৈরী হওয়া ইমিউনিটি মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রেও কিছুটা ইমিউনিটি দিবে এটাই স্বাভাবিক। তবে স্মলপক্স ভ্যাক্সিনের কার্যকরি রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা ভ্যাক্সিন দেয়ার ৫ বছর পর থেকে কমতে থাকে। অতএব, দেশে যারা স্মলপক্সের ভ্যাকসিন পেয়েছেন এখন তাদের শরীরে এমপক্স প্রতিরোধের মত কোন ইমিউনিটি থাকার কথা নয়। তবে তারা যদি মাঙ্কিপক্স ভাইরাসে সংক্রমিত হোন তাহলে তাদের রোগের তীব্রতা হয়তো কিছুটা কম হবে এবং এ থেকে মৃত্যু ঝুঁকিও কিছুটা কম হতে পারে।
মাঙ্কিপক্সের ক্ল্যাড-ওয়ান ভ্যারিয়েন্টে মৃত্যুহার তুলনামূলক বেশি যা বর্তমানে ৩-৪ শতাংশ। এই ভাইরাসটিই এখন আফ্রিকার গোন্ডি পেড়িয়ে ছড়িয়ে পরেছে ইউরোপসহ বেশ কিছু দেশে। পকিস্তানেও মাঙ্কিপক্সের রোগি সনাক্ত হয়েছে। আমাদের দেশেও সম্ভবত একটি মাঙ্কিপক্স কেইস পাওয়া গেছে। যদিও খবরটির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে। একমাত্র পিসিআর টেস্টের মাধ্যমেই এই ভাইরাসটি সঠিকভাবে সনাক্ত করা সম্ভব।
মাঙ্কিপক্স রোগের লক্ষণের সাথে স্মলপক্সের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। সংক্রমণের পরে জ্বর এবং গায়ে ব্যাথা দিয়ে মাঙ্কিপক্সের শুরুটা হলেও দু-এক দিনের ভেতরেই সারা গায়ে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। এই ফুসকুড়ির পরিমান এবং তীব্রতা গুটি বসন্তের মতই, তবে অতিপরিচিত চিকেনপক্স বা জলবসন্তের চেয়ে তীব্রতা অনেক কম। এই ফুসকুড়িগুলো পেঁকে পরবর্তিতে শুকিয়ে খোসা হয়ে ঝরে পরতে সময় লাগে ২-৩ সপ্তাহ। চিকেনপক্সের মতই মাঙ্কিপক্সও সেল্ফলিমিটিং অর্থাৎ কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এই রোগটি একা একাই ভাল হয়ে যায়।
মাঙ্কিপক্সের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। তবে শরীরে ফুসকুড়ি দেখার সাথে সাথে এন্টিভাইরাল ওষুধ সেবন করলে রোগের তীব্রতা কিছুটা কমতে পারে। মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে ইম্ভানেক্স নামের যে ভ্যাকসিনটি বাজারে রয়েছে তা মূলত গুটিবসন্তের ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিনটি অবশ্য সবার জন্য প্রযোজ্য নয়।
যুক্তরাজ্যে যাদের মধ্যে মাঙ্কিপক্স হওয়ার প্রবনতা বেশি তাদের জন্যই এই ভ্যাকসিনটি দেয়ার রিকমেন্ডেশন রয়েছে। চিকেনপক্সের মতই মাঙ্কিপক্স অত্যান্ত ছোঁয়াচে। অর্থাৎ মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কোন রোগির সাহচর্যে আসলে যে কারোরই এই রোগটি হতে পারে। তবে, পুরুষ স/ম/কা*মী বা যেসব পুরুষ পুরুষের সাথে যৌ/ন- সংসর্গ করে বা যাদের একাধিক যৌ£ন পার্টনার রয়েছে তাদের মধ্যে মাঙ্কিপক্স হওয়ার হার অনেক বেশি। এই ধরনের মানুষদেরকে যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে ভ্যাকসিন নেয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশে জনসাধারনের মধ্যে এখনই মাঙ্কিপক্স নিয়ে ভয় বা উদ্বেগের কোন কারণ নেই। তবে সরকারকে অনেক সতর্ক হতে হবে যাতে করে দেশে মাঙ্কিপক্স ঢুকতে না পারে।
২০২২ সালে মাঙ্কিপক্স ছড়িয়ে পরেছিল ১০০ টিরও বেশি দেশে। এবারও ছড়াচ্ছে দ্রুতগতিতে। দেশে মাঙ্কিপক্স সনাক্তে পর্যাপ্ত পিসিআর টেস্ট কিটের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিমানবন্দর এবং স্থলবন্দরে শক্ত মনিটরিং ব্যবস্থা এবং কার্যকরি কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিশেষ করে মধ্য এবং উত্তর আফ্রিকা থেকে যারা দেশে প্রবেশ করছেন তাদের পূর্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং হিস্ট্রি নিতে হবে।
দেশে চিকেনপক্স সাধারণত শীতকালে হয়। অতএব এই সময়টিতে কোন প্রকার চিকেনপক্স দেখা দিলেই তার জন্য পিসিআর পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে এবং রোগিকে বাসায় বা হাসপাতালে আইসোলেশনে রাখতে হবে। চিকেনপক্সের ইমিউনিটি মাঙ্কিপক্সে কোন প্রতিরোধ দেয় না। সুতরাং যাঁদের পূর্বে একবার চিকেনপক্স হয়েছে তাদের যদি এসময় আবার পক্স হয় তাহলে তা হাল্কা ভাবে না নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
সরকারী এবং ব্যাক্তিগত পর্যায়ে সবাই সতর্ক হলে মাঙ্কিপক্সে তেমন কোন বিপর্যয়ের সম্ভাবনা নেই।
লেখকঃ
ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম
সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট,
শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, ইউকে।