যে কারণে শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের প্রয়োজন
প্রতীকী ছবি।
মানুষের শরীরে নির্দিষ্ট পরিমানে ইউরিক অ্যাসিডের প্রয়োজন হয়। তার বেশি হলে সেটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এইজন্য খাদ্যাভাস নিয়ন্ত্রণসহ নিয়মতান্ত্রিক জীবন-যাপনে ইউরিক অ্যাসিডের ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। সম্প্রতি ডক্টর টিভিতে ডা. শারমিন ইয়াসমিন খানের সঞ্চলনায় ইউরিক অ্যাসিডের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিউমাটলজিস্ট অধ্যাপক ডা. আতিকুল হক।
ডক্টর টিভি: ইউরিক অ্যাসিড কী? যদি সহজ করে বুঝিয়ে বলুন।
অধ্যাপক ডা. আতিকুল হক: ইউরিক অ্যাসিড শব্দটা একটু কঠিন, কারণ- এটা একটি রাসায়নিক বস্তু। এটা আমাদের রক্তের মধ্যে থাকে, শরীরের মধ্যেও থাকে এটা আমাদের শরীরের মধ্যে তরল অংশে দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। বিশেষ করে যারা রসায়ন, বিজ্ঞানে পড়ালেখা করেছেন তারা জানে আমাদের যা কিছু দ্রবণীয় থাকে যেমন লবণ, একটা শরবত এর মধ্যে চিনি এগুলো দ্রবণে থাকে। যদি একটা নির্দিষ্ট ঘনত্ব পার হয়ে যায় তাহলে তারা দ্রবণ অবস্থা থেকে বের হয়ে একটা সলিড অবস্থায় আসে। এটাকে দানা বা ক্রিস্টাল বলা হয়।
ইউরিক এসিড আমাদের শরীরের মধ্যে এমন একটা মাত্রায় থাকে, যদি কিছুটা বাড়ে তাহলে সেটা দ্রবীভূত অবস্থা থেকে একটা সলিড আকারে এটা বের হয়ে আসতে পারে দানা আকারে। যখন আমাদের জয়েন্টের রসে এ ধরণের দানা বের হয়ে আসে, ওই দানার কারণে তখন জয়েন্টের মধ্যে প্রচণ্ড প্রদাহের সৃষ্টি হয়। সেই প্রদাহের কারণে জয়েন্টের মধ্যে রসটা বেড়ে যায়, জয়েন্ট ফুলে ওঠে, যখন ইউরিক এসিডের কারণে জয়েন্টে এই ধরণের একটা প্রদাহ হয়, তীব্র ব্যথার আক্রমণ হয় তখন সেটাকে বলা হয় গাউট। গাউট আসলে পৃথিবীতে অনেক আগেই শনাক্ত হয়েছে।
বলা হয়ে থাকে কলম্বাসের গাউট ছিল। ১৭১৯ সালে জেমস গিলারি নামে একজন শিল্পী ছিলেন তিনিও গাউটে আক্রান্ত ছিলেন এবং তিনি তার গাউটের ব্যথার চিত্রটা একটা চিত্রের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন একটা ছবিতে। যাতে মনে হচ্ছে একটা বড় দৈত্য তার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে কামড় দিচ্ছে। গাউট হচ্ছে একটা বাত, ইউরিক এসিড দ্বারা বের হয়ে আসার কারণে যে বাতটার জন্ম হয়, অনেকেই মনে করেন বিশেষ করে যাদের পরিবারের গাউট আছে। বাত মানেই গাউট এ কথাটা পুরোপুরি ঠিক না, বাত আছে ৬৭২ রকমের। সেই ৬৭২ রকমের মধ্য থেকে গাউট হচ্ছে একটা।
গাউটের প্রাদুর্ভাব কিন্তু আমাদের দেশে খুব বেশি না, কিছু কিছু দেশে খুব বেশি। আমাদের দেশে গাউট ছাড়া অন্যান্য বাত আমরা বেশি পেয়ে থাকি। কিন্তু যে সমস্ত পরিবারে গাউট আছে সে সমস্ত পরিবারের সদস্যরা গাউটের সাথে যথেষ্ট পরিচিত। পশ্চিমা দেশগুলোতে যেমন ব্রিটেন আমেরিকা, গাউট একটা সাধারণ ইংরেজি শব্দ হিসেবে প্রচলিত হয়ে গেছে। অনেক রোগী আছেন যাদের গিরায় ব্যথা হলে ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলে আমার গাউট হয়েছে।
তারা আসলে ডাক্তারকে বোঝারও সুযোগ দেন না যে, তার বাতটা আসলে কোন ধরণের বাত। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, গাউটটা হচ্ছে একটা টাইপের বাত। গাউটটা বাতের সমার্থক না, গাউট ছাড়া আরো অন্যান্য রকমের বাত আছে। তারমানে আমরা বলবো যে সব গাউট বাত কিন্তু সব বাত গাউট নয়।
ডক্টর টিভি: ইউরিক অ্যাসিড শরীরে কি বেশি থাকতে পারে? এটা কি নির্দিষ্ট কোন দেশ বিশেষ আছে বা বাঙালিদের শরীরেও থাকতে পারে? আর যদি থাকে সে ক্ষেত্রে করণীয় কী?
অধ্যাপক ডা. আতিকুল হক: ইউরিক অ্যাসিড সবারই থাকে আমাদের শরীর আসলে ইউরিক অ্যাসিড ছাড়া চলবে না। আমাদের জীবনে চলার জন্য ইউরিক অ্যাসিড অপরিহার্য। এটা আমাদের কিছু রোগ থেকে রক্ষা করে। ডিমেনশিয়া থেকে কিন্তু ইউরিক অ্যাসিড আমাদের রক্ষা করে। ইউরিক অ্যাসিডের আমাদের শরীরের জন্য সত্যিকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা ৭ পর্যন্ত আমরা নরমাল বলি। কিন্তু সাথে বেশি হলে আমরা সেটাকে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড বলি। এটাকে আমাদের ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় হাইপার ইউরেমিয়া।
হাইপার ইউরেমিয়া বা রক্তের মধ্যে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড এটা খুবই সাধারণ একটা ঘটনা, অনেকেরই এটা বেশি হয়ে থাকে। তাইওয়ান-ইন্দোনেশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, সুস্থ মানুষদের শতকরা ২০ থেকে ২৪ ভাগের রক্তের মধ্যে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি। এই ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি হওয়াটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো ক্ষতি করে না। আমেরিকায় এমন একটা গবেষণায় দেখা গেছে যে, যাদের ইউরিক অ্যাসিড বেশি থাকে, তাদের শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ ইউরিক অ্যাসিডজনিত কোন রোগে আক্রান্ত হন।
বাকি শতকরা ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ সারা জীবন শরীরে রক্তের মধ্যে ইউরিক অ্যাসিড বয়ে বেড়ান কিন্তু ইউরিক এসিড জনিত কোন রোগে আক্রান্ত হন না। তারমানে ইউরিক অ্যাসিড বেশি থাকলে সেটা রোগ, তা কিন্তু বলা যাবে না। গাউটের ব্যথার কিন্তু প্যাটার্ন আছে। যাদের ইউরিক অ্যাসিড বেশি তাদের সঠিক গাউটের প্যাটার্নের ব্যথার যদি আক্রমণ হয়, তখনই আমরা বলব এই মানুষটা ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড বাতের সৃষ্টি করেছে। তখন আমরা বলতে পারবো এই মানুষটা, এই ভদ্রলোক একজন গাউটের রোগী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইউরিক অ্যাসিড বেশি পাওয়া গেলও তাদের কোনো বাত থাকে না।
ডক্টর টিভি: অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক ডা. আতিকুল হক: ডক্টর টিভি পরিবারকেও ধন্যবাদ। সকল দর্শক, পাঠক ও শ্রোতাদেরও ধন্যবাদ।
[অনুলিখন: আমিনুল ইসলাম]