স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতা করোনার সাথে সম্পৃক্ত নয়: ডক্টর টিভিকে পরিকল্পনামন্ত্রী
বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালনকারী এম এ মান্নান সরকারের দক্ষ একজন আমলা ছিলেন। সর্বশেষ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে ২০০৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন তিনি। এর আগে এম এ মান্নান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যুগ্মসচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক এবং এনজিও ব্যুরোতে মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ডুংরিয়া গ্রামের সন্তান এমএ মান্নান সারগোদায় অবস্থিত পাকিস্তান এয়ারফোর্স স্কুল থেকে ও লেভেলে উত্তীর্ণ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রির পর ১৯৭৪ সালে তদানীন্তন সিএসপি ক্যাডারে যোগ দেন। তিনি জেলা প্রশাসক কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামসহ সরকারের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের ইকোনমিক মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আব্দুল মান্নান ২০০৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার তিন বছর পর দলটি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১০ এবং ২০১৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সফলতার সঙ্গে দায়িত্বপালন করেন। তার স্ত্রী জুলেখা মান্নান ঢাকা উইমেন্স কলেজের শিক্ষিকা ছিলেন। তার চিকিৎসক মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাস জীবন যাপন করছেন। আর ছেলে সাদাত যুক্তরাজ্যের বার্কলেইস ক্যাপিটাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
দেশের করোনাপরবর্তী স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন ডক্টর টিভির সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ব্যারিস্টার সাবরিনা জেরিন
ডক্টর টিভি: করোনাপরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী?
এম এ মান্নান: এইট প্লাস প্রবৃদ্ধি অর্জন করা। দারিদ্র কমিয়ে প্রায় এক পঞ্চমাংশে নামিয়ে ফেলা। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মৌলিক কিছু অসামঞ্জস্যতা ছিল। গ্রামে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খুবই অবহেলিত ছিল। গ্রামে আমাদের ৪ ভাগের তিনভাগ মানুষ বাস করেন। তাদের জন্য যে স্বাস্থ্যের অবকাঠামো থাকার দরকার তার ১০ ভাগের একভাগও গ্রামে ছিল না।
সেখান থেকে বেরিয়ে এসে গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবার মাধ্যমে, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স, এগুলোকে আরো জোরদার করা, ইউনিয়ন হেলথ কমপ্লেক্সগুলোকে আরো জোরদার করা ইত্যাদি করে আমরা স্বাস্থ্যসেবায় আমরা চাচ্ছি যে ইমব্যালেন্স (বৈষম্য) আছে। সেটাকে দূর করে সকল মানুষ বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য একটি একটি গ্রহণযোগ্য মানের স্বাস্থ্যসেবা প্রধানত স্বাস্থ্য শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া, যাতে মানুষ সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। যেমন বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ সম্পর্কে যেনো জানতে পারে সেগুলো যেনো দমন করতে পারে। ইতিমধ্যে ম্যালেরিয়া বসন্ত কলেরা আমরা দমন করতে পেরেছি। এছাড়া অন্যান্য রোগ সম্পর্কে জানানো। এ বিষয়ে ডাক্তাররা ভালো বলতে পারবেন। আমাদের পরিকল্পনা হলো-অসংক্রামক রোগ যেমন হার্ট, ব্রেইন, কিডনি, এগুলো অ্যাড্রেস করার জন্য ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা। ইতিমধ্যে আমরা কিছু ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছি।
ডক্টর টিভি: করোনাকালে স্বাস্থ্যখাতের সকল দুর্বলতা প্রকট আকারে বেরিয়ে এসেছে, সেগুলোর সমাধানে সুনির্দিষ্ট কী কী পরিকল্পনা রয়েছে?
এম এ মান্নান: স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতা করোনার সাথে সম্পৃক্ত নয়। যদিও করোনা আমাদেরকে অনেক কিছু শিক্ষা দিয়েছে। তবে আমাদের মৌলিক কিছু দুর্বলতা ছিল। কারণ এই দেশটি গড়ে উঠেছে ঔপনিবেশিক মানসিকতায়। যার মধ্যে অন্যতম বৈষম্য হচ্ছে শহর এবং গ্রামভিত্তিক বৈষম্য। গ্রামকে মনে করা হয় পশ্চাদভূমি। অর্থাৎ গ্রামের মানুষও উৎপাদন করবে শহরের মানুষ খাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সেটাকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ এ প্রজন্মে ১৯৯৬ সালে যখন ক্ষমতায় আসে, স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থা চালু হয়। এর মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটা গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছেছে।
যদি আমরা শতভাগ সফল হতে পারেনি। বাস্তবায়নে কিছুটা দুর্বলতা ছিল। তবে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর গ্রামের মানুষের সাথে যোগাযোগটা আমাদের বৃদ্ধি হয়েছে। আর মানুষ পূর্বের তুলনায় অনেকটাই সচেতন হয়েছে। ফলে সার্বিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং অতি দরিদ্র মানুষের জন্য ৩০ থেকে ৩৫ টা ঔষধ বিনামূল্যে তাদেরকে দিয়ে যাচ্ছি। যদিও আমাদের পরিকল্পনা ছিল প্রতিদিন একজন ডাক্তার দিয়ে সেগুলোকে সমন্বয় করা। নানা কারণে পারিনি। বিশেষ করে ডাক্তারের অভাব, তাছাড়া উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া ডাক্তারদের গ্রামে কাজ করার অনীহা প্রকাশ।
আমরা উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সগুলোকে নতুন করে সাজিয়েছি। এখানে নানা ধরনের ইকুইপমেন্ট দিয়েছি যদিও কিছু অভিযোগ রয়েছে অনেক জায়গায় ইকুইপমেন্ট ভালো নয়, যার কারণে কাজ করতে পারছে না। এছাড়া জনবলের অভাব রয়েছে, তার মধ্যেও আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তবে সেই দুর্বলতাগুলো অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি আমরা। আমরা মেডিকেল এডুকেশন ব্যবস্থা বৃদ্ধি করেছি। বিগত কয়েক বছরে অনেকগুলো সরকারি এবং বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ মালিকদের আমরা উৎসাহিত করেছি স্বাস্থ্য শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে। নার্সদের পাওনা মর্যাদা এ সরকার দিয়েছে, প্রয়োজনে আরো বৃদ্ধি করা হবে। সততাই আমাদের বিশাল কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে এবং বাকিগুলো বাস্তবায়নের পথে। এসব কিছু বাস্তবায়ন করতে অবশ্যই কিছু অর্থের দরকার। প্রয়োজনে আমরা বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ করব। যদি সেই উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। আমাদের স্বাস্থ্যসেবা উন্নত বিশ্বের মতো নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। কারণ আমাদের অর্থনীতির ভিত মজবুত হচ্ছে। বিদেশি ঋণ কিংবা টেকনিক্যাল সহযোগিতা পেলে সেটাকে স্বাগতম জানাবো। তবে না পেলেও আমরা কোনভাবেই হতাশ নই।
সর্বোপরি স্বাস্থ্যশিক্ষা, হেলথ টেকনোলজি, হেলথ ইকুইপমেন্ট, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যেখানে রোগীরা ভর্তি থাকবে আর পাশাপাশি মেডিকেল স্টুডেন্ট পড়াশোনা করবে। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে যে ক্লিনিকগুলো রয়েছে সেখানে অক্সিজেনের ব্যাপক সাপ্লাই অংশগ্রহণ করব, আর এগুলোতে বেশি করে মনোযোগ দিব। আমি যতদিন দায়িত্বে আছি ততদিন এ কাজগুলো বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করব।
ডক্টর টিভি: করোনা পরবর্তীকালে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার কী কী পরিকল্পনা গ্রহণ করছে?
এম এ মান্নান: প্রথমে স্বীকার করে নেওয়া উচিত আমি কোন বিশেষজ্ঞ নই আমি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি। তবে হ্যাঁ অবশ্যই আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে। আমরা একটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি, যা ১৮ কোটি মানুষের জন্য অনেক বিরাট একটি পরিকল্পনা। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা মধ্যে আমাদের উন্নয়নের সকল দিক আলোচিত হয়েছে। এই পঞ্চবার্ষিকী এর উদ্দেশ্য হলো বিগত আমলে আওয়ামী লীগ সরকারের যাবতীয় ইতিবাচক অর্জন গুলো ধরে রাখা। যদিও কোভিড-১৯ আমাদের সে পরিকল্পনায় অনেকটাই আঘাত করেছে। প্রায় এক বছরের মত আমাদেরকে পিছিয়ে দিয়েছে। যদিও কোভিডকে সামনে রেখে আমাদের পথ চলতে হবে।
আর আমাদের এই পরিকল্পনার মধ্যে প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য হবে সম্প্রতি আমাদের উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখা, দারিদ্রতা নামিয়ে ফেলা, হতদরিদ্রের সংখ্যা ১ দশমাংশে ধরে রাখা, শিশুদের জন্য আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও আধুনিকায়ন করা। গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করা যেমন কমিউনিটি ক্লিনিককে আরো প্রসারিত করা, ইউনিয়ন কমপ্লেক্সগুলোকে আরো জোরদার করা, সর্বোপরি আমরা স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে একটি ভারসাম্য এ নিয়ে আসতে চাই।
বিশেষ করে দারিদ্র্য শ্রেণির মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি স্বাস্থ্য শিক্ষাকে আরো ত্বরান্বিত করা। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি, তবে কৃষিকে আরো সম্প্রসারণ করতে হবে। বিদ্যুতায়ন আমাদের শতভাগের কাছাকাছি অর্জন হয়েছে। এখন দায়িত্ব হচ্ছে স্বচ্ছ ও সততার সাথে সেটিকে ব্যবহার করা এবং বিদ্যুৎ শতভাগ নিশ্চিত করা। এছাড়া আরো অনেক বিষয় রয়েছে এই পরিকল্পনার মধ্যে।
ডক্টর টিভি: দারিদ্র্যসীমার নিচে অনেকেই বসবাস করেছেন, নতুন করে করোনার কারণেও অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়ে দারিদ্রতায় যুক্ত হচ্ছেন। স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি এসব মানুষদের জন্য আপনার কী কী পরিকল্পনা রয়েছে?
এম এ মান্নান: এটা সত্যি যে করোনার কারণে অনেক মানুষ চাকরি হারাচ্ছেন এবং দরিদ্র হচ্ছেন। আর এই মানুষগুলোই শহর ছেড়ে গ্রামের ছুটে যাচ্ছেন। অনেকটা ভিতি, আশঙ্কা, অনিশ্চয়তাসহ নানা কারণেই চলে যাচ্ছেন। ফলে বিভিন্ন সেক্টরেই সমস্যা দেখা দিয়েছে।
সবচেয়ে বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে দিন আনে দিন খায় এমন শ্রেণির মানুষ। তবে আমরা সাধারণ ছুটি কে দীর্ঘায়িত করিনি, সবকিছুকে পুনরায় চালু করে দিয়েছি। যাতায়াত ব্যবস্থা আমরা পুরোপুরি বন্ধ করিনি যদিও অনেকে এটাকে সমালোচনা করেছে। এখন প্রায় সবকিছুই স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। অনেকেই ঢাকায় ফিরে এসেছে। যে সকল মানুষদের চাকরি হারিয়েছে তারা কোন চাকরি পাচ্ছে। ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক খাত আবার চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। বিদেশীরা বিনিয়োগ করা শুরু করেছে।
ব্যাংকিং লেনদেন ব্যবসা-বাণিজ্য আগের মতোই শুরু হচ্ছে। যেখানে ২০ ভাগে নেমে এসেছিল, সেখানে আমরা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ এগিয়েছি। তবে আমার বিশ্বাস আগামী ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যে আমরা সম্পূর্ণভাবে সফল হব, যদি এই মহামারী আরও কমে যায়। এবং আমরা দেশের বাইরে শ্রমিক অব্যাহতভাবে পাঠাবো। সুতরাং সবকিছুই আমরা সঠিকভাবে এগিয়ে নেব, দারিদ্রতা দূর করার চেষ্টা করব, যদিও দারিদ্রতা শতভাগ দূর করা সম্ভব নয়।
ডক্টর টিভি: মাননীয় মন্ত্রী আমাদের দীর্ঘ সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
এম এ মান্নান: আপনাকেও ধন্যবাদ এবং ডক্টর টিভির দর্শকদেরও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।