প্রেগন্যান্সি মানেই ঝুঁকিপূর্ন
অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগম
NEAR MISS
প্রসূতিবিদ্যা বা অবস্টেট্রিক্সের ভাষায় Near miss মানে হোল মাকে প্রায় হারিয়ে ফেলা। অর্থাৎ মরতে মরতে যে মা বেঁচে যায়।
প্রেগন্যান্সি মানেই ঝুঁকিপূর্ন। তাই সারা বছর এন্টিন্যাটাল চেক আপে থেকে কোন সমস্যা না থাকা স্বত্তেও প্রসবকালীন যে কোন জটীলতা দেখা দিতে পারে।এজন্যই এন্টিন্যাটাল চেক আপের উপকারীতা বর্ননার শেষ কালে উপসংহার টেনেছে এই বলে যে " সবকিছু ঠিক থাকার পরেও মাকে সুস্থ রেখে একটি সম্পূর্ন সুস্থ বাচ্চা জন্মদানের নিশ্চয়তা দেয়া যায় না।"
তিনদিন ধরে আবহাওয়ার দশ নাম্বার সঙ্কেত দেবার পরে মানুষ এত এলার্ট হয়ে যায় যে সেই দশ নাম্বার ঝড় নাও আসতে পারে আর এলেও মানুষের জীবনের নাশ কমই হয়ে থাকে। আর হঠাৎ যে সুনামিটা এল, টের পাবার আগেই সম্পূর্ন লোকালয় ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
অবসটেট্রিক্সের দশ নাম্বার সঙ্কেত অনেকগুলো আছে, যেটার জন্য প্রসবকালীন সব রকম সতর্কতা অবলম্বন করা হয়ে থাকে। ডেলিভারী কোথায় হবে, কখন হবে রাতে নাকি দিনে, কে করাবে, কিভাবে হবে, কতরকমের কনসালট্যান্ট উপস্থিত থাকবে, কয়ব্যাগ ব্লাড রেডি থাকবে ইত্যাদি। কিন্তু যেখানে কোন সঙ্কেতই নেই, যেই ডেলিভারীতে বেবী গড়িয়ে গড়িয়ে চলে আসে সেই ডেলিভারী দাইরা করায়। শুধু ধপাস করে পরে যেয়ে ব্যাথা না পায় সেটার জন্য ধরে ফেলে। আর হাসপাতালে মিডওয়াইফ করায়। সেরকম কেইসগুলোতেও সুনামি হতে পারে। হঠাৎ করে মারা যেতে পারে। "এমনিওটিক ফ্লুইড এমবোলিজম"। ফুসফুসের রক্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়া। কার্ডিয়াক এরেস্ট। হঠাৎ হৃদপিন্ডের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া। প্রসবত্তোর রক্তক্ষরন, পানিভর্তি মাটির কলসীতে একটা বারি মারলে যেমন পানি পরে ফ্লোর ভিজিয়ে দেয় তেমনি অকল্পনীয় রক্তক্ষরন হয়ে লেবাররুম বা ওটির ফ্লোরে সুনামি হওয়া।
এগুলো তড়িতগতিতে ম্যানেজমেন্ট করলে বাঁচানো যেতেও পারে, নাও যেতে পারে। মারা গেলেতো দুর্ভাগ্য, বেঁচে গেলে এদেরকে বলি "near miss"। এজন্য যে সে চলে যাচ্ছিলে প্রায়। তাকে আমরা মিস করতে যাচ্ছিলাম।
দশ নাম্বার সঙ্কেতেরগুলোরও কারো কিছুই হয়না, কেউ কেউ আবার চলে যেতে যেতে ফিরে আসতে পারে।
রাত আড়াইটায় আইভির টেলিফোন, আপা গাড়ী পাঠিয়েছি, শিগগীর একটু মারকাজুলে আসেন। পিপিএইচ ( প্রসবোত্তর রক্তক্ষরন)। যেই ড্রেসে ছিলাম তাই পরেই চলে গেলাম। ওটি রক্তে ভেসে গেছে। সুনামি। পেশেন্টের ভাই ডাক্তার। জরায়ু কেটা ফেলা বাঞ্চনীয়। রোগী ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাবে। বুঝিয়ে বললাম যে ওকে মেডিকেলে নেবার পথে মারা যাবে। পথে মারা না গেলেও ওখানে সবকিছু এরেঞ্জ করতে করতে মারা যাবে। এখানে সব যেহেতু রেডি আছে ডাবল রিস্ক বন্ড দাও আমরা শেষ চেষ্টা করি। যেহেতু টেবিলেই মারা যেতে পারে তাই ডাবল রিস্ক বন্ড। শুধু ডাক্তার বলে সহজেই বোঝানো গেল এবং পেশেন্টকে বাঁচানো গেল। যে কোন মুহূর্তে সে মারা যেতে পারত। এমন একটি গল্প নয়৷ অনেকটিই আছে।
আর এই গল্প শুধু আমার নয়। এদেশের প্রতিটি অবস্টেট্রিসিয়ানের এমন গল্প আছে। আপনি তা জানেন কি? না এই দুঃসাহসিকতার গল্প আপনি জানেন না। কারন এটা খবর হয়না। এটাতে সংবাদপত্রের কাটতি বাড়ে না। টি আর পি বাড়ে না। তাই শত সহস্র Near miss এর কাহিনী অজানাই থেকে যায়। শুধু মারা গেলেই ভুল চিকিৎসা হয়ে যায়। বাংলাদেশের এই দুঃসাহসিক অবস্টেট্রিসিয়ানরা এমন শত শত কেসকে ফিরিয়ে এনে মাতামৃত্যুর হার কমিয়ে এম ডি জির লক্ষ্য পূরন করেছে। তার ফলশ্রুতিতে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুরুষ্কৃত হয়েছেন।
যে কোন চিকিৎসক তার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে পেশেন্ট বাঁচাতে। আল্লাহ কি মানুষের জীবন চিকিৎসকের হাতে দিয়ে দিয়েছে? না। সব চেষ্টার পরেও বাঁচাতে না পারলে অবস্টেট্রিসিয়ানের বুকের ঝড়, বুকের ব্যথা কেউ দেখেনা।
তবুও যদি কখনও মনে হয় চিকিৎসা সঠিক হয়নি তাহলে অভিযোগ করুন, তার তদন্ত হোক, তদন্তে সঠিক চিত্র বেরিয়ে আসুক তারপরে কারো অবহেলা হলে তাকে শাস্তি দিন। তার আগে কাউকে জেলে নিয়েন না। কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলিয়েন না। পেশেন্ট যেমন আপনার দেশের, চিকিৎসকও আপনার দেশের। একজনকে ভালবাসতে গিয়ে আর একজনার উপর অবিচার করবেন না। এমন চলতে থাকলে NEAR MISS এর গায়ে কেউ হাত দিতে সাহস পাবে না।