স্বাস্থ্যসেবা ভোগে বৈষম্য: বাংলাদেশে গ্রামীণ ও শহুরে অঞ্চলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পার্থক্য
"স্বাস্থ্যসেবা ভোগে বৈষম্য: বাংলাদেশে গ্রামীণ ও শহুরে অঞ্চলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পার্থক্য"
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ও মানের মধ্যে অসামঞ্জস্য বিদ্যমান আছে, যা বর্তমানে উদ্বেগ হিসাবে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশের বর্তমান চিত্র অনুযায়ী এই বৈষম্য মূলত অনেক ক্ষেত্রেই প্রকাশিত হচ্ছে; যেমন- অর্থনৈতিক বৈষম্য, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্যতা, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, অভ্যন্তরীণ বৈষম্য, অর্থায়ন এবং অবকাঠামো, প্রাইভেট সেক্টরের প্রভাব। Bangladesh Health Watch এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, শহুরে এলাকায় ৬৭% স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার পাওয়া যায়, যেখানে গ্রামীণ এলাকায় এটি মাত্র ২৫%। এ ধরনের অসমতা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বড় পার্থক্য সৃষ্টি করে।
শহর ও গ্রাম অঞ্চলের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার বড় পার্থক্য দখা যায়। শহরাঞ্চলে উন্নত চিকিৎসা সুবিধা ও আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায়, তবে গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং অপ্রতুল সুযোগ রয়েছে। উচ্চ আয়ের জনগণ উন্নত হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সাথে সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন, কিন্তু নিম্ন আয়ের জনগণের জন্য এ ধরনের সুযোগ সীমিত। তারা সাধারণত কম দক্ষ চিকিৎসকদের কাছে যান অথবা স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর উপর নির্ভরশীল থাকেন। অনেক অঞ্চলে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা এবং শিক্ষা কম। ফলে, অনেক মানুষ স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানেন না এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব বুঝতে পারেন না। নারীদের স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও বৈষম্য দেখা যায়, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলিতে। নারী স্বাস্থ্যসেবার অভাব, বিশেষত গর্ভবতী নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা উপলব্ধতা কম। সরকারী স্বাস্থ্যসেবার অভাবনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাব রয়েছে। ফলে, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির অবস্থা এবং সেবা প্রদান যথাযথভাবে করা সম্ভব হয় না। প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলির প্রভাব বাড়ছে, যা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করছে। এই সেক্টরের সেবা উচ্চমানের হলেও তা অনেক সময় অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী নয়। এই বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠনগুলোও কাজ করছে। তবে, এই সমস্যা সমাধানে আরও কার্যকরী নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের প্রয়োজন।
বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন নতুন উদ্যোগ ও উন্নয়ন প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে- নওগাঁ জেলায় "অভিনব স্বাস্থ্যসেবা" প্রকল্পের আওতায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। স্যানিটেশন, চিকিৎসা সরঞ্জাম, এবং চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে গ্রামীণ জনগণ উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে রোগীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গাজীপুর জেলায় "মোবাইল ক্লিনিক" প্রকল্প শুরু হয়েছে, যেখানে মোবাইল হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য ক্লিনিক গ্রামীণ এলাকায় ঘুরে ঘুরে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে। এর ফলে দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণ স্বাস্থ্যসেবা সহজেই পাচ্ছে, বিশেষ করে যে এলাকায় স্থায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। কক্সবাজারে "টেলিমেডিসিন" সেবা চালু করা হয়েছে, যেখানে গ্রামীণ এলাকার জনগণ ভিডিও কলের মাধ্যমে শহরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারে। এর ফলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সহজলভ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং রোগীরা দূরবর্তী স্থানে না গিয়ে প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছেন। এছাড়াও আরও রয়েছে বরিশাল জেলার "স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন প্রকল্প", মুন্সিগঞ্জ জেলার "নিরাপদ মাতৃত্ব প্রকল্প", “মহানগর স্বাস্থ্য প্রকল্প” - সিলেট, মাধবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য প্রকল্প। এই ধরনের প্রকল্পগুলো গ্রামীণ অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করতে এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে বৈষম্য কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই উদ্যোগগুলো আরও সম্প্রসারিত হলে এবং অন্যান্য অঞ্চলেও বাস্তবায়িত হলে দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
গ্রামীণ ও শহুরে স্বাস্থ্যসেবার পার্থক্য কমানোর জন্য সরকার ও অন্যান্য সংস্থাগুলি নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে। এর কিছু কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে যেমন- স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ ও আধুনিকীকরণ, ডিজিটাল স্বাস্থ্য অবকাঠামো, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর প্রশিক্ষণ ও বরাদ্দ, প্রেষণা ও বেতন বৃদ্ধি, মোবাইল ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যক্যাম্প, অর্থায়ন ও বাজেট বরাদ্দ, স্বাস্থ্যসেবা প্রণয়ন ও মূল্যায়ন। এই পদক্ষেপগুলো গ্রামীণ ও শহুরে স্বাস্থ্যসেবার পার্থক্য কমাতে সাহায্য করবে এবং দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বৈষম্য দূর করতে সুষম নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন একটি জটিল প্রক্রিয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে যে কার্যকর কৌশলগুলো গুরুত্বপূর্ণ তা হল- প্রত্যেকের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, নীতি-প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, সামাজিক নির্ধারকদের উপর নজরদারি করা, স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং অবকাঠামো উন্নয়ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রস্তাব করে যে, স্বাস্থ্যসেবা সবার কাছে সহজলভ্য করতে হবে, বিশেষত যারা অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল এবং সামাজিকভাবে প্রান্তিক অবস্থানে আছে। এই নীতি ও উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সুষমতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য দূর করতে সাহায্য করবে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই বৈষম্য দূর করতে গ্রামীণ অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ডাক্তার ও নার্সদের উপস্থিতি বাড়ানো এবং সঠিকভাবে পরিচালিত স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করা জরুরি। WHO এবং UNICEF এর মত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশে গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষামূলক কর্মসূচি এবং কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মীদের ভূমিকা বাড়ানো উচিত। এছাড়া, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা এবং ডিজিটাল হেলথ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বৈষম্য কমাতে এবং গ্রামীণ ও শহুরে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবধান কমানোর জন্য আমাদেরও কিছু পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবার প্রকল্পগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা , স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করা ,রেড ক্রস বা গ্রামীণ স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর সাথে কাজ করার মাধ্যমে আমরা সরাসরি কমিউনিটির মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় সহায়তা করতে পারেন। এছাড়াও, ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প এবং রক্তদান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে মানবতার সেবায় অবদান রাখতে পারি। স্থানীয়ভাবে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ওষুধ বিতরণ কর্মসূচি আয়োজন করা যেতে পারে। অনেক সময় এই ধরনের স্বেচ্ছাসেবী কর্মসূচি দ্বারা দরিদ্র মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্তি সহজ হয়। এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে আমরা এসডিজি-র গোল নিশ্চিত সহ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে অবদান রাখতে পারি এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বৈষম্য কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারি।