চিকিৎসা বিজ্ঞানের একাল ও সেকাল
বিগত শতকগুলোতে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিজ্ঞানের অবিস্মরণীয় উন্নতির সাথে সাথে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের। চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত এবং যারা এ পেশার বাইরে, তারাও চিকিৎসার বর্তমান এবং অতীত তুলনা করলে বিস্ময়ে হতবাক না হয়ে পারবেন না। বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা মানুষকে অবাক অভিভূত করছে না শুধু, আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে, রোগ নির্ণয় ও রোগ সারাতে যেমন অগ্রগতি হয়েছে, তেমনি মানুষের সুস্থ জীবন যাপনের নিশ্চয়তা বাড়াতে নানা ধরনের গবেষণা হয়েছে, এখনও হচ্ছে।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে পিছনে তাকালে দেখা যায়, কি অসাধ্যই না সাধন করেছে বিজ্ঞানের কল্যাণে। অতীতে যে সকল স্বাস্থ্যগত সমস্যাকে মনে হত প্রকট এবং অনতিক্রম্য, ক্রমে ক্রমে বিজ্ঞানীদের চেষ্টায় তার অনেকগুলোকেই অতিক্রম করতে পেরেছে মানুষ। অতীতে রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, ওষুধপত্র এমনকি পাঠ্য বইও ছিল সীমিত। শুধু তাই নয়, চিকিৎসার ধারণা এবং রোগ নির্ণয় পদ্ধতি ভুলে ভরা ছিল। ভুল হয়তো নয়, অজানা ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই আল্লাহর উপর ভরসা করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে রোগ, রোগ নির্ণয়, ওষুধ, এক কথায় সর্বক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, জয় করা গেছে বহু দুরারোগ্য ব্যাধিকে, শল্য চিকিৎসায় অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে, জিনতত্ত্ব জানবার সাথে সাথে উন্মোচন হয়েছে অনেক জটিল রোগের কারণ ও ব্যাখ্যা।
পাঠ্যবই:
আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগেও মেডিকেল শিক্ষার পাঠ্য বইয়ের সংখ্যা ছিল নিতান্তই সীমিত, ফলে শিক্ষাদান পদ্ধতিও ছিল সীমিত। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে কোন বিষয়েই পাঠ্য পুস্তকের বিপুল সমাহার হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন রকমের চিকিৎসা বিষয়ক জার্নালের ছড়াছড়ি। এ সমস্ত প্রকাশনা গুলো বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত, রং বেরংয়ের ছবি ও পরিসংখ্যান সম্বলিত সহজ সরল ভাষায় উপস্থাপিত হওয়ায় চিকিৎসা বিজ্ঞান হয়েছে আরোও সমৃদ্ধশালী।
তথ্য ও প্রযুক্তি:
চিকিৎসা বিজ্ঞানে সেকালের তুলনায় একালে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টির অগ্রগতি দেখা যায় তা হল তথ্য ও জ্ঞানের সমাহার বা প্রাপ্তির সুযোগ। দেহের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সব বিষয়ের খুঁটিনাটি এখন আমাদের জানা, কোষ এবং তারও ভেতর উপাদানগুলো কীভাবে কাজ করে, কীভাবে বংশগতি প্রবাহিত হয় এবং কীভাবেই বা সমন্বিত হয় কোষ ও কলার কাজ সমূহ, কোন সামান্য প্রোটিনের ভুলে বা কোন ছোট্ট ডিএনএ জনিত ত্রুটি বিচ্যুতির দরুন দেখা দেয় জটিল অনেক রোগ।
এসব তথ্য আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। আর “ইনফরমেসন টেকনোলজির” এই যুগে বাংলাদেশের গণ্ডগ্রামে বসে একজন জেনারেল ফিজিশিয়ানও চাইলে, যে কোন রোগ সম্পর্কে সার্বিক তথ্য জেনে নিতে পারেন ঘরে বসেই, সর্বশেষ আবিষ্কারের বিষয়ে আপডেট হতে পারেন যে কোন সময়, লাইব্রেরিতে ঘন্টার পর ঘন্টা সময়। নষ্ট না করেই, শুধু কম্পিউটারের ওয়েব সাইটে বা ইন্টারনেটে চাপ দিলেই হল। আজকাল প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেই অনেক রোগী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যে কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে সহজেই রোগ ব্যাধি নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে পারেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পারেন। এই তথ্যের ভাণ্ডার ব্যবহার করেই এগিয়ে গেছে রোগ নির্ণয়ের সকল আধুনিক পদ্ধতি।
প্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষা:
আশির দশকের আগেও প্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষা নিরীক্ষা বলতে মনে হত, একজন ডাক্তার, সামনে একটি টেবিল ও মাইক্রোস্কোপ নিয়ে বসে আছেন। আর পরীক্ষা বলতে প্রস্রাব, পায়খানা, রক্তের কিছু পরীক্ষা এবং সামান্য কয়েকটি এক্সরে করা হতো। অথচ কার না জানা পাতলা পায়খানা, বমি এবং অজ্ঞান হলে সিরাম ইলেক্ট্রোলাইট পরীক্ষা করা অতিব জরুরী। ১৯৮০ সালের পূর্বেও রক্তের ইলেক্ট্রোলাইট এর মতো অত্যন্ত জরুরী পরীক্ষা করাও সম্ভব হতো না, বর্তমানে যা অতি সহজেই করা সম্ভব।
রক্তের সুগার টেস্ট ১ মিনিটেই করা সম্ভব। প্রাইভেট ল্যাবরেটরী ছিল না বললেই চলে। কিন্তু বর্তমানে অনেক অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন প্রাইভেট ল্যাবরেটরির ছড়াছড়ি, যা দেখলে অবাক না হয়ে উপায় নেই। অথচ ২০-২৫ বছর পূর্বেও আমরা কোথায় ছিলাম। যে কোন রকম রক্তের বায়োকেমিক্যাল পরীক্ষা, আন্ট্রাসনোগ্রাফি, এম আর আই, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি অনেক সহজেই করা সম্ভব।
এমআরআইয়ের আবিষ্কার অবশ্যই এক যুগান্তকারী সংযোজন, যার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের, বিশেষ করে ব্রেন ও হাড়ের অনেক জটিল রোগ অতি সহজেই নিরূপণ করা সম্ভব হচ্ছে। বিজ্ঞানের কল্যাণে আরো অনেক অজানা জটিল রোগ নির্ণয়ে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ল্যাবরেটরি ও প্যাথলজির পরীক্ষা নিরীক্ষা আজ অনু পরমাণু পর্যায়ে রোগের কারণ ও ধরন নির্ণয় করতে পারছে। জেনেটিক এনালাইসিস, ক্রমোজোমাল এনালাইসিস, ক্যারিওটাইপিং, মলিকুলার বায়োকেমিস্ট্রি ও ইমিউনলজি রোগের ধরণ ধারন কারণ ব্যাখ্যা করতে পারছে একেবারে সঠিক পদ্ধতিতে। রেডিওলজির অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে, ইমাজিংয়ের নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার দেহের ভেতরকার সমস্ত চিত্রই তুলে আনতে পারছে নির্ভুলভাবে।
চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধ:
৩০-৪০ বছর আগেও অনেক ওষুধ দুষ্প্রাপ্য ছিল এবং আবিষ্কৃত হয় নাই। রোগ আরোগ্যের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের যুগান্তকারী আবিষ্কারের পর থেকেই এগিয়ে গেছি আমরা, জীবাণু ও সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হার মেনে বিদায় নিয়েছে অনেক জটিল ব্যাধি। এক সময়কার ভয়াবহ রোগ বলে বিবেচিত কলেরা, প্লেগ, ম্যালেরিয়া, যক্ষা, কুষ্ঠ, গুটিবসন্ত, টিটেনাস ইত্যাদি ভয়াবহ রোগ পরাজিত হয়েছে বিজ্ঞানের কাছে। যদিও জন্ম হচ্ছে এইডস, এইচওয়ান এনওয়ান জাতীয় নতুন নতুন জীবাণুর এবং তৈরি হচ্ছে এন্টিবায়োটিক রেজিসটেন্স, তবু সংক্রামক ব্যাধি আজ আর বড় কোন সমস্যা নয় পৃথিবীতে।
এক সময় কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি রোগ ছিল ভয়াবহ। এগুলো বর্তমানে প্রায় সম্পূর্ণ ভাবেই বিলুপ্ত । অথচ এগুলো নিয়ে গ্রামে কত আজে বাজে অবাস্তব ধারণাই না ছিল। কলেরা, বসন্ত রোগ সম্পর্কে এর পিছনে জীন ভূত অথবা কোন অপশক্তি আছে বলে মনে করা হতো। এবং এর জন্য ঝারফুক তাবিজ-কবচ ইত্যাদির রমরমা ব্যবসা ছিল। এই অপশক্তি তাড়ানোর জন্য মৌলভি সাহেবেরা কাগজে দোয়া দরুদ লিখে দিতেন, যা বাড়ির প্রবেশ পথে সুপারি গাছ বা বড় গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা হতো, উদ্দেশ্য ছিল ঐ অপশক্তি আর প্রবেশ করবে না। রাত্রি বেলায় উচ্চস্বরে ছুরা পড়ে কলেরা ও বসন্তের জীন-ভূত তাড়ানো হতো। মানুষ মনে করতো, এভাবেই এই অপশক্তিগুলো অন্যত্র চলে যাবে। অথচ হাজার হাজার মানুষ মারা যেত।
কলেরা হলে পানি পান করতে দেওয়া হতো না, অথচ পানিই এই রোগের জন্য অতীব জরুরী। যারা লুকিয়ে পানি পান করতো, তারাই বেঁচে যেতো। কোন গ্রামে কলেরা বা বসন্ত হলে, ঐ এলাকার মানুষ পালিয়ে অন্যত্র চলে যেতেন এবং অন্য গ্রাম থেকে আর কেউ উক্ত গ্রামে প্রবেশ করতেন না। আক্রান্ত রোগীদেরকে একঘরে করে রাখা হতো, ভয়ে কেউ সেবা শুশ্রুষা করতো না।
এভাবে অযত্নে বিনা চিকিৎসায় রোগী মারা যেত। আর এখন শুধুমাত্র খাবার স্যালাইন খেলে ১০০ ভাগ রোগীর বাচা সম্ভব। সামান্য খাবার স্যালাইন কি বিপ্লবই না সাধন করেছে। যক্ষা সম্পর্কে একসময় মানুষের ধারণা ছিল “যার হয় যক্ষা তার নাই রক্ষা।” বিজ্ঞানের কল্যাণে নতুন ওষুধের দ্বারা যক্ষা সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। ফলে এখন বলা যায়, “যার হয় যক্ষা তার হয় রক্ষা।” এভাবে ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড এবং কুষ্ঠ ইত্যাদির ক্ষেত্রে অনেক কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কারের ফলে মানুষ এ সকল রোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য সহজ লভ্য চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ করতে সক্ষম হচ্ছে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার:
হৃদরোগের চিকিৎসায় যে উন্নতি সাধিত হয়েছে তা রীতিমতো বিস্ময়কর। অতীতে হৃদরোগে কেউ আক্রান্ত হলে মনে করা হতো, “পরপারের যাত্রার টিকেট কাটা হয়ে গেছে”। কারণ ওষুধ-পত্রও তেমন কিছু ছিল না। অথচ একালে নিত্যনতুন ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে, ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি ও বাইপাসসহ বিভিন্ন রকমের অত্যাধুনিক কার্ডিয়াক সার্জারি বর্তমানে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশেও মানুষের হাতের মুঠোয়। কিডনী বিকল হবার চিকিৎসায় ডায়ালাইসিস এবং সফল কিডনী প্রতিস্থাপন এখন হরহামেশাই হচ্ছে, এমনকি সম্ভব হয়েছে লিভার, প্যানক্রিয়াস ও অন্যান্য টিস্যু প্রতিস্থাপনও।
ক্লোনিং পদ্ধতিও বিজ্ঞানের আরেক বিস্ময়কর আবিষ্কার, যার সাহায্যে যে কোন প্রাণীর একটি টিস্য নিয়ে তার অনরূপ আর একটি প্রাণী ল্যাবরেটরীতে জন্ম দেওয়া সম্ভব। অদূর ভবিষ্যতে ক্লোনিংকে কাজে লাগিয়ে আরও সব কত্রিম অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তৈরি ও প্রতিস্থাপনও সহজ হতে চলেছে। শল্য চিকিৎসায় অ্যানেসথেশিয়া ও এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার এনেছে সফলতার উচ্চ হার। প্লাস্টিক সার্জারি মানুষকে সুন্দর অবয়ব দিতে সহায়তা করছে। এন্ডোস্কপিক সার্জারি, লেসার সার্জারি, গামা নাইফ সার্জারি ইত্যাদির কারণে বড় ধরনের কাটা ছেড়া ছাড়াই সম্ভব হচ্ছে বড় ধরনের অপারেশন। লেজার সার্জারি, ক্রায়োথেরাপি, ইলেক্ট্রোকটারি ইত্যাদির মাধ্যমে নানা রকমের চর্মরোগের সহজ ও কার্যকর চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে। ধাত্রীবিদ্যায় গর্ভস্থ শিশুর সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা সহজে সম্ভব হওয়ায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া ও সঠিক সমস্যা নিরুপণ করা যাচ্ছে, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানো গেছে অনেকাংশেই। টেস্টটিউব বেবী পদ্ধতিটি আরেক বিস্ময়। অতীতে নিঃসন্তান দম্পতিরা শুধুমাত্র একটি সন্তানের জন্য ঝাড়-ফুক, তাবিজ-কবচ, মাজারে মানত সহ ডাক্তার কবিরাজের স্মরনাপন্ন হতেন এবং ব্যর্থ হয়ে হতাশায় ভুগতেন।
বর্তমানে টেস্ট টিউব পদ্ধতির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ নিঃসন্তান মায়ের মুখে তৃপ্তির হাসি ফোটানো সম্ভব হয়েছে সারা পৃথিবী জুড়েই। চোখের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও অত্যাধুনিক লেন্স লাগানো থেকে শুরু করে অতি জটিল অপারেশনও খুব সহজেই করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, যারা বধির বা কম শুনেন, সেই সমস্ত কানের রোগীদেরও অত্যাধুনিক চিকিৎসা, যেমন- ককলিয়া ইমপ্ল্যান্টেশন প্রয়োগের মাধ্যমে যুগান্তকারী চিকিৎসা করা সম্ভব হয়েছে।
আধুনিকায়নের কুফল:
তবে এটাও সত্য যে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও উন্নতির সবটুকুই সুফল বয়ে আনেনি, দুর্গতিও এনেছে প্রচুর। আগের জমানায় রোগী কম ছিল, চিকিৎসার সুযোগও ছিল অপ্রতুল। ডাক্তারদের ভুল ভ্রান্তি কম হতো এবং অজানা ছিল অনক কিছুই। কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যা বর্তমানে অনেকাংশেই ল্যাবরেটরী রিপোর্ট ও ইমেজিং নির্ভর হয়ে পড়ার কারণে হয়ে উঠেছে ব্যয়বহুল। বিশ্বের অনেক দেশেই উন্নত চিকিৎসা চলে গেছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। বিশ্বায়ন ও বাজার সংস্কৃতির প্রভাব থেকে চিকিৎসা বিদ্যাও মুক্ত হতে পারেনি বলে চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। এক সময়ের দেবতুল্য স্থান থেকে চিকিৎসকেরা নেমে এসেছেন কপোরেট ব্যবসায়ীর কাতারে। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানের সেকাল ও একাল বিশ্লেষণ করতে গেলে ভালো মন্দ দুই দিকই চলে আসে, আলোর নীচের অন্ধকার টুকুও ফেলে দেয়া যায় না।
ডাক্তারের কাছে রোগের ইতিহাস ও রোগীর শারীরিক পরীক্ষা আজ হয়ে উঠেছে কম গুরুত্বপূর্ণ, ক্লিনিক্যাল জাজমেন্ট কমে যাচ্ছে। যেহেতু এতে অহেতুক সময় নষ্ট করার চাইতে ল্যাবরেটরীতে রোগ নির্ণয় অনেক সহজ ও নিরাপদ, ডাক্তাররা পরীক্ষার উপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এতে চিকিৎসা বিদ্যার মূল আর্টই অনেকাংশে যাচ্ছে হারিয়ে। চিকিৎসকের ক্লিনিকেল স্কিল কাজে না লাগালে এক সময় হয়তো চিকিৎসক নয়, ল্যাবরেটরিতে রোবটই চিকিৎসা করার ভার পুরোপুরি নিয়ে নিতে পারবে।
রোগীর কথা মনোযোগ সহকারে না শুনে, ভালো ভাবে রোগীকে পরীক্ষা না করায় অনেক রোগ সঠিক ভাবে নির্ণয় হচ্ছে না বা ভুল হচ্ছে। তাতে ডাক্তার রোগীর সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। ডাক্তাররা যদি রোগীর রোগের ইতিহাস ভালোভাবে শোনেন, তবে অনেক রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। তাতে করে অযথা অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সাপেক্ষ পরীক্ষা নিরীক্ষা এড়ানো সম্ভব। আর্থিক অসামর্থের দরুন অনেক ব্যয়বহুল টেস্ট করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। অনেক ক্ষেত্রেই অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যয়ভার রোগীকে মাথা পেতে নিতে হচ্ছে, সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে সুচিকিৎসার সুযোগ। পরীক্ষা নিরীক্ষা রোগ নির্ণয়ে অবশ্যই সহায়ক, কিন্ত অপপ্রয়োগে রোগীকে গিনিপিগ বানানো অযৌক্তিক ও অনৈতিক। দেখা যায়, অনেক নামি দামী ক্লিনিকে না বুঝেই চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগী নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসেন।
কপোরেট সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে চিকিৎসা সেবার উপরও, বেশির ভাগ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালের কাছে রোগী এখন রোগী নন, বরং ক্লায়েন্ট এবং সেবাদান কোন পেশা নয়, বরং বাণিজ্য। চিকিৎসা সেবা চিকিৎসকদের কাছ থেকে ক্রমেই চলে যাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি, কর্পোরেট অফিস, চেইন প্রতিষ্ঠান বা ব্র্যান্ড ওষুধ কোম্পানিদের হাতে, যারা চিকিৎসা সেবাকে আর সেবা নয়, বরং মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা হিসেবই দেখতে অভ্যস্ত। আর চিকিৎসকরাও এদের হাতের পুতুল হতে বাধ্য হচ্ছেন। চিকিৎসক রোগী সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি হয়েছে। একদিকে যেমন চিকিৎসকদের আত্মবিশ্বাস কমেছে, নৈতিকতা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে তেমনি রোগীও তার আস্থা হারাচ্ছেন, শ্রদ্ধার অভাব দেখা দিচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বেড়েই চলেছে। উন্নতির সাথে সাথে একালে এই অন্ধকারটুকু যোগ হয়েছে চিকিৎসা জগতে এবং বেড়েই চলেছে।
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে যে কাজগুলো এখনই করা দরকার তা হচ্ছে-
প্রথমতঃ চিকিৎসকের ক্লিনিকাল স্কিল ও জাজমেন্টের ওপর পূর্ণ আস্থা সৃষ্টি করা এবং এ বিষয়ে আরও দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করা।
দ্বিতীয়তঃ প্রয়োজনীয় ও সঠিক উপায়ে ল্যাবরেটরি ও প্যাথলজির সাহায্য নেয়া।
তৃতীয়তঃ চিকিৎসকদের নৈতিক শিক্ষাদান ও বাজার ব্যবস্থা থেকে চিকিৎসা সেবাকে রক্ষা করার মাধ্যমে। চিকিৎসক রোগীর সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা যখন পণ্য হয়, তখন তার গুণগত মান নিম্নমুখী হওয়াই স্বাভাবিক। জ্ঞান বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি ও অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে চিকিৎসা বিদ্যাকে সঠিক ও সুন্দর পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরকেই। বিশেষ করে আমরা যারা এই মহান পেশায় জড়িত।