এইডস আক্রান্ত ছেলেটা ভেবেছিল সে একটু অন্যরকম

ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু
2024-01-27 11:34:27
এইডস আক্রান্ত ছেলেটা ভেবেছিল সে একটু অন্যরকম

এইডস আক্রান্ত ছেলেটা ভেবেছিল সে একটু অন্যরকম (ইনসেটে ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু)

২-৩ মাস আগের কথা নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের আউটডোরে রোগী দেখছি। বেশ চাপ। মাথাব্যথা নিয়েই বেশিরভাগ রোগী আসেন। বেলা ১২টার দিকে ২৪-২৫ বছরের একটা ছেলে আসে। আমি বসতে বললাম।

বসার পর জিজ্ঞেস করলাম, সমস্যা কি? মাথাব্যথা?

ছেলেটা নির্মোহ গলায় বলল, আমি এইডসে আক্রান্ত।

ছেলেটার মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখলাম না। ওর এইডস হয়েছে শুনে আমিই ভয়ে কুকড়ে গেলাম। কারণ আমার ১৪-১৫ বছরের চিকিৎসক জীবনে এ-ই প্রথম এইডস আক্রান্ত কোন রোগী দেখলাম। তাছাড়া ছেলেটার বয়স কম। ওর ভবিষ্যৎ চিন্তা করেও আমি মনে মনে খুব বিচলিত হয়েছিলাম।

আমি বললাম, এটা তো নিউরোলজিকাল হাসপাতাল। আপনাকে যেতে হবে মহাখালী।
ছেলেটা বলল, আমি বিএসএমএমইউ-তে দেখিয়েছি। তারা কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা দিয়েছে। ওখানে টাকা অনেক বেশি লাগে তাই সরকারি হাসপাতালে এসেছি।

পরীক্ষাগুলো লিখে ছেলেটাকে বিদায় দিলেই পারতাম। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমার মানুষের জীবনের ঘটনা জানার আগ্রহ খুব।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এইডস হয়েছে জানলেন কিভাবে? পরীক্ষায় ভুল আসেনি তো?
ছেলেটা বলল, কিছুদিন আগে তার সিফিলিস ধরা পড়ে। চিকিৎসায় ভালো হয়। এ-র মাস ছয়েক পর কি মনে করে আশার আলো নামক এক এনজিও-তে গিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে প্রথমে ধরা পড়ে তার এইডস। পরে বিএসএমএমইউ-তে আরোও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছে।

কেন ছেলেটা এইডস আক্রান্ত হয়েছে তা জানার জন্য আমি বললাম, শরীরে কখনো রক্ত দিতে হয়েছে?

এত নিষ্পাপ একটা চেহারা খারাপ কিছু মাথায় আসছিলো না।
সে খুব নির্মোহ ভাবে বলল, আমি হোমোসেক্সুয়াল।
আমি দ্বিতীয়বারের মতো ধাক্কা খেলাম।

তার সাথে কথা বলে যা জানলাম, তাহলো সে ছোটবেলা থেকেই একটু অন্যরকম ছিলো। ছেলে হলেও সে মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করত না। এভাবেই বড় হচ্ছিলো। পরে উত্তরবঙ্গের হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার জন্য ভর্তি হয়। মেসে থেকে লেখাপড়া করত। মেসের পাশে পায়ের দোকানে একদিন পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের এক শিক্ষকের সাথে। সে শিক্ষক খুব স্মার্ট, আধুনিক মানসিকতার। কথাবার্তায়ও বেশ।

ছেলেটার সে শিক্ষককে ভালো লাগে। তাদের সাথে ফোনালাপ চলতে থাকে। একসময় তাদের মধ্যে ভাব-ভালবাসা হয়। তা পরিনত হয় শারীরিক সম্পর্কে। প্রায় ৫ বছর চলে সে সম্পর্ক।
চারুকলার সে শিক্ষক পরিবার এতটাই আধুনিক যে, ছেলেটাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। বাবা-মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারা একসাথে থাকবে বলে ঠিকও করে। ছেলেটা পড়াশুনা শেষ করে ঢাকায় চলে আসে। বেশ ভালোই চলছিলো দিনগুলো।

মাস ছয়েক আগে হঠাৎ করে ছেলেটা সিফিলিসে আক্রান্ত হয়। চিকিৎসা করানোর পাশাপাশি সেই শিক্ষককে জানান। এটা জানার পর থেকে সে শিক্ষক তাকে এড়িয়ে চলা শুরু করে। চিকিৎসায় সিফিলিস ভালো হলেও আগের সম্পর্ক আর ভালো হয় না। বেশ কয়েকবার ও-ই শিক্ষকের সাথে দেখা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় সে। এমনকি তাকে মেরে বাসা থেকে বের করে দেয়া হয় কয়েকবার।

ছেলেটা একা, অসহায় হয়ে পরে। এখন সে জানতে পারে- সে এইডসে আক্রান্ত। কিভাবে চিকিৎসা করাবে তা নিয়ে চিন্তিত।

এখন তার উপলব্ধি কি জানতে চাইলে ছেলেটা জানায়, আমি মারাত্মক ভুল করেছি। আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল। আমি ভুল মানুষকে বিশ্বাস করেছিলাম। স্মার্ট, সমাজের চোখে আলোকিত ও আধুনিক মানসিকতার মানুষের ভেতরটা যে কতটা অন্ধকার তা এখন হারে হারে টের পাচ্ছি। কুৎসিত মানসিকতার মানুষটি দ্বারা আজ আমি এইডসে আক্রান্ত।
কিভাবে নিশ্চিত হলেন আপনি তার দ্বারাই আক্রান্ত?

ছেলেটা বলে, আমি অন্য কারোও সাথে কখনই জড়িত হয় নাই। ও-ই শিক্ষক পিএইচডি করার জন্য চায়নায় ছিলো কিছু দিন। আমার মনে হয় সেখানেই সে আক্রান্ত হয়েছে। উনি আসলে জানেন উনি এইডসে আক্রান্ত। না হলে আমার সিফিলিস হয়েছে শোনার পর কেন আমাকে ছুড়ে ফেলে দিলেন?

এ বিকৃত সমাজের লোকদের ব্যবহার শুরুতে অত্যন্ত অমায়িক, ফেরেশতাদের মত হলেও এদের ভেতরটা অত্যন্ত জঘন্য, কুৎসিত।

তার কাছে জানতে চাই সমাজে এমন বিকৃত মানসিকতার মানুষের হার কেমন?

ছেলেটা জানায়, এ হার কিন্তু কম নয়। তবে বেশিরভাগই বিকৃত যৌনাচারের জন্য এমন করে।
এলজিবিটিকিউ আন্দোলন নিয়ে জানতে চাইলে ছেলেটা জানায়, আমি এ ধরনের মিটিং সিটিং এ খুব কমই গেছি। তারা আসলে যা চায় তা অবাধ যৌনাচারের স্বাধীনতা।
ছেলেটাকে একটা অনুরোধ করলাম, প্লিজ কাউকে সংক্রমিত করবেন না।
ছেলেটা মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে চলে গেলো। আমি নিরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম শুধু।

লেখকঃ

ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু

সহকারী অধ্যাপক
ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস। 


আরও দেখুন: