নয়নতারার স্বামী কেন আসে না?

ডা. সাঈদ এনাম
2024-01-13 13:15:40
নয়নতারার স্বামী কেন আসে না?

বাইপোলার মুড ডিসওর্ডার আক্রান্ত প্রতীকী নারী (ইনসেটে ডা. সাঈদ এনাম)

কিছু কিছু রোগীর কাহিনী অনেক সময় চিকিৎসকদের মনকেও দুখ ভারাক্রান্ত করে ফেলে। সেটা মেডিসিন, নিউরোমেডিসিন বা সাইকিয়াট্রি সব বিষয়েই আছে।

রোগাক্রান্ত মানুষ একটা সময় চরম অসহায়ত্বে ভোগে, অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হয়। রোগতো আছেই সেই সাথে কখনও কখনও যোগ হয় পরিবারের নিকটজনের কাছ থেকে অবহেলা।

‘নয়নতারা’ (ছদ্মনাম) বয়স উনিশ। তার আচার-আচরণ বেশ অস্বাভাবিক। যে কাউকে দেখলে সে রেগে যায়, তেড়ে আসে। একা একা সে প্রচুর কথা বলছে গোছালো বা অগোছালো। একা একা হাসছে।

ঘুম নেই একেবারে। মাঝেমধ্যে এতোসব যৌক্তিক কথা বলে যে অবাক হয়ে সবাই, আবার মাঝেমধ্যে অযৌক্তিক অগোছালো। এগুলো প্রায় এক সপ্তাহ।

নয়নতারা বার বার তার স্বামীর কথা বলছিলো। তার স্বামী আসেনা, খবর নেয় না? স্বামীর তাকে খুব ভালোবাসে। স্বামীকে তার দেখতে খুব ইচ্ছে হয়। তার স্বামীর মতো ভালো মানুষ আর দ্বিতীয়টি নেই।

স্বামীর গল্প করে করে সে কেঁদে দিচ্ছে বার বার।

কিন্তু নয়নতারার স্বামী নেই। তাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে বিয়ের ৩ দিনের মাথায়।

ব্যাপারটা হলো, গেলো বছর ধুমধামে নয়নতারার বিয়ে হয়। কিন্তু বাসর ঘরেই নয়নতারার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এক দিন, দুই দিন, তিন দিন থাকে। গ্রামের মোল্লা, তান্ত্রিক, কবিরাজ সবার এক কথা, তাকে ‘ভুতে ধরেছে’, ‘খারাপ বাতাস' লেগেছে। ৩ দিনে চিকিৎসার নামে তার উপর চলেছে ভয়ংকর চলেছে ‘অপচিকিৎসা’, ‘নির্যাতন’ আর ‘অপবাদ’।

অতঃপর ভালো না হওয়ায় স্বামীর বাড়ির সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা ডিভোর্স করিয়েছে। নয়নতারার স্বামী রাজী ছিলেন না। কিন্তু মায়ের চাপে সে রাজী হয় এক সময়। নয়নতারার শ্বাশুড়ি বললেন, ‘এ পাগল মেয়ে নিয়ে আজীবন চলা যাবে না।’

উপায়ান্তর না দেখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হয় নয়নতারা'র স্বামী।

শ্বশুর বাড়ি থেকে নয়নতারা'কে তার মা বাবা নিয়ে আসতে বাধ্য হন। তারা প্রথমে তাবীজ, মোল্লা এসব চিকিৎসা করেন। পরে তারা সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান। সাইকিয়াট্রিস্ট এর অল্প ক'দিনের চিকিৎসায় নয়নতারার সকল সিমটম চলে যায়। সে সম্পুর্ন সুস্থ হয়ে যায়।

এরপর কিছু অভিভাবক পুনরায় ইসলামিক আইন মেনে আগের সংসার জুড়ো লাগানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রাক্তন শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, ননদ কেউই রাজী হয়নি।

সেই থেকে নয়নতারা মা বাবার কাছে। বিগত কয়েকমাস সে সম্পুর্ন সুস্থ ছিলো। সে কলেজে ভর্তি হয়েছে আবার। তার বিয়ের জন্য পাত্রও দেখা হচ্ছিলো। কিন্তু গেলো কয়েকদিন যাবৎ হঠাৎ করে তার আবার মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। মানসিক সমস্যা দেখার আগে তার ঘুম কমে যায়।

পূর্বে সাইকিয়াট্রিস্ট এর চিকিৎসায় যেহেতু নয়নতারা সম্পুর্ন সুস্থ হয়েছে তাই তারা দেরী না করে আবার দ্রুত সাইকিয়াট্রিস্ট এর শরণাপন্ন হয়েছেন।

নয়নতারা পুনরায় সুস্থ হয়ে উঠবে। এ মানসিক রোগের নাম বাইপোলার মুড ডিসওর্ডার। এরোগ মাঝেমধ্যে দীর্ঘ বিরতিতে দেখা দেয়। ধরুন রোগী গত বছর হঠাৎ করে অসুস্থ হলো, কয়েক সপ্তাহ অসুস্থ থাকলো আবার চিকিৎসায় দ্রুত সেরে গেলো। আবার হঠাৎ এক বছর পর কোন মানসিক চাপ বা স্ট্রেস এ পড়ে দেখা দিলো। অর্থাৎ রোগটির যথাযথ চিকিৎসা না হলে বিরতিতে ফিরে আসে।

নয়নতারা অসুস্থ হলে খালি আগের স্বামীর কথা বলে। 'স্বামী কেনো নিতে আসেনা, স্বামী কেনো নিতে আসেনা' এ বলতে অনেক কাঁদে সে। কিন্তু ভালো থাকলে সে বুঝে তার ডিভোর্স হয়েছে।

আগের স্বামী যাতে ফের নয়নতারাকে ফিরিয়ে নিতে না পারে সেজন্যে তারা শাশুড়ী ননদ ছেলেকে দ্রুত বিয়ে করিয়ে দিয়েছেন। ইসলামি ধর্ম ও শরিয়া মতে নয়নতারা তার আগের স্বামীর কাছে ফিরতে পারবেনা।

সবচেয়ে আশ্চর্যের হলো, মানসিক রোগ গুলোর মধ্যে বাইপোলার মোড ডিসওর্ডার এর চিকিৎসা সফলতা বেশী। রোগী চিকিৎসায় দ্রুত ভালো হয় তবে এ রোগেত চিকিৎসা ২/৩ বছর চলমান রাখতে হয়। চলমান থাকলে এরোগ সম্পূর্ন সেরে যায়।

লিখেছেন-

ডা. সাঈদ এনাম
সহকারী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি)
সিলেট মেডিকেল কলেজ। 


আরও দেখুন: