একটি চশমাগাথা দিয়ে যে কাহিনী শুরু
অধ্যাপক ডা. সালেহ উদ্দিন
সে অনেক দিন আগের কথা- কেমন করিয়া পচিশ বছর কাটিয়া গেলো ভাবিয়াও পাইনা। আগে বলা হইতো- ‘সময় আর নদীর ঢেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে না।’ এখন বন্যা, অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল ছাড়া নদীতে ঢেউ দেখা যায় না- কিন্তু সময় নিজস্ব নিয়মে অতিক্রান্ত হইতেছে- কাহারও কিছু বলিবার নাই।
যাক সে কথা- তখন আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চক্ষু বিভাগীয় চেয়ারম্যান। বিসিপিএস পরীক্ষার নিয়মিত পরীক্ষক ও লিখিত পরীক্ষায় বড় বড় হলের সার্বিক তত্ত্বাবধান করি।
একদিন সকালের কথা। গ্যালারিতে পরীক্ষার দায়িত্বে আছি। প্রশ্নপত্র বিলি হইয়াছে। প্রশ্নপত্র পাওয়ার পর সকলের অনুভূতি অনুমান করার প্রয়াস আমার চিরন্তন অভ্যাস। প্রশ্নপত্র পাইয়া সকলেই লিখা শুরু করিয়াছে- কেবলমাত্র দ্বিতীয় বেঞ্চের একজন ছাড়া। তাহার কাছে গেলাম- দেখিলাম- সে একবার প্রশ্নপত্র কাছে নিতেছে- আবার সরাইয়া রাখিতেছে- লিখিবার কোন উদ্যোগ নাই। তাহার সমস্যা কি জিজ্ঞাসা করিলে বলিল- সে চশমা আনে নাই, তাই লিখিতে পড়িতে পারিতেছে না। তার শুধু পড়াশুনার জন্য চশমা লাগে- দূরের দৃষ্টিতে কোন সমস্যা লাগে না- প্রশ্নের উত্তরে সে বলিল তার বয়স ৪২।
এ আমি এই তথ্য লইয়া এই বয়সের আমার কনিষ্ঠ সহযোগীদের খোঁজ করিতে লাগিয়া গেলাম। তাহার ভাগ্য ভাল- একজনকে পাইলাম। সে দিতে দিতে শুধু বলিল- যে নিজের ব্যাপারে এত উদাসীন, সে ভুল করিয়া পরীক্ষা শেষে আমার চশমাটি নিয়া যাইবে। স্যার, আমার চশমাটিও একেবারে নতুন ও দামী।
আমি বলিলাম, সে দায়িত্ব আমার। তারপর কিছু সময় কাটিয়া গেল, আমি আমার দায়িত্ব পালন করিতে গিয়া এক সময় চশমার কথা বেমালুম ভুলিয়া গেলাম। পরীক্ষা শেষ হইল। খাতা গ্রহন করা হইতেছে। হটাৎ খেয়াল হইল চশমার কথা। দেখি কথিত ছাত্রটি নাই, তাড়াতাড়ি বেয়ারাকে পাঠাইলাম। সে তখন শেষ গেট হইতে তাহাকে ডাকিয়া আনিল। তাহাকে চশমার কথা বলিতে সে শুধু বলিল- ভুল করিয়া নিয়া গেছিলাম। বুঝিলাম- আসলেই ভুল হইয়াছে। আসলে পৃথিবীতে ইহারা এক ধরনের মানুষ- যাহারা নিজের স্বার্থ আর পরের স্বার্থের ব্যাপারে একই রকম উদাসীন। ইহাদের জন্য নিজের ও নিজের পরিবারের জন্য মধ্যে মধ্যে ক্ষতিকারক হইলেও সামগ্রিকভাবে সবসময় সমাজের জন্য ক্ষতিকারক নহে।
আর এক প্রজাতির মানুষ আছে- যাহারা নিজ স্বার্থ ও পরের স্বার্থের ব্যাপারে সমভাবে সচেতন। তবে এই ধরনের Balanced মানুষের সংখ্যা খুবই কম।
আর এক প্রজাতির মানুষ আছে- যাহারা নিজের স্বার্থের ব্যাপারে সম্পূর্ন সচেতন, কিন্তু পরের স্বার্থের ব্যাপারে সম্পূর্ন উদাসীন- ইহাদের কাছে অন্যের স্বার্থের কথা চিন্তা করার কোন সময় নাই। যে কোন ভাবে ইহারা দেশ ও সমাজের স্বার্থ নষ্ট করিয়া ইহারা নিজস্ব স্বার্থ সংরক্ষন করে। বর্তমান সময়ে ইহাদের সংখ্যা অসম্ভব হারে বাড়িয়া গিয়াছে- ইহাদের পদভারে দেশ ও সমাজ প্রকম্পিত।
একটি কাহিনী বলিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হইবে। আমি তখন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে। আমাদের নতুন এক সহকর্মী আসিয়াছেন- তাহার সাথে আমার পরিচয় নাই বা ছিল না। নতুন কোন সহকর্মী আসিলে আমি সপরিবারে তাহার খোঁজ খবর নিতে যাই। ইহা আমার অনেক দিনের অভ্যাস- তাহাদের সুবিধা অসুবিধার কথা শুনি। সম্ভব হইলে অসুবিধা দূরীকরণের চেষ্টা করি। তাহাদের কথা শুনিয়া মনে হইল তাহাদের একটিই অসুবিধা- সেটি হইল তাহার একমাত্র মেয়ে - যে এস এস সি পরীক্ষার্থী, তাহার জন্য একটি শিক্ষক দরকার।
আমার মেয়ে রুশমিয়া তখন এস এস সি পরীক্ষার্থী। তাহার জন্য অনেক কষ্টে আমার স্ত্রী একটি শিক্ষক যোগাড় করিয়াছেন মাস খানেক আগে। তিনি একবেলা রুশমিয়াকে পড়ান। আমার স্ত্রী অকপটে এই কাহিনী ভদ্র মহিলাকে বলিলেন এবং তাহাকে আশ্বস্ত করিলেন যে, বিকালেই তিনি উক্ত শিক্ষককে পাঠাইয়া দিবেন। বিকালেই শিক্ষককে তাহার বাসায় দিয়া আসিলেন।
তিনদিন গেল- উক্ত শিক্ষক এখন আর আমার বাসায় আসেন না। আমার স্ত্রী চিন্তিত হইলেন। পরে খোঁজ নিয়া জানিতে পারিলেন- উক্ত শিক্ষককে তিনগুণ বেশি দিয়া তিনি দুইবেলার জন্য রাখিয়া দিয়াছেন। আর এত টাকার লোভ শিক্ষক মহাশয় সংবরন করিতে পারেন নাই।
আমার শিক্ষিত সহকর্মীর জন্য লজ্জাবোধ হইল। আমার স্ত্রী আক্ষেপ ও দুঃখবোধ করিতে লাগিলেন। আমার তখন মনে হইতে লাগিল- নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটকে সেই ভাঁর গোলাম হোসেনের কথা- যে সর্বস্বান্ত নবাবকে বলিতেছিল ‘নিজের ধন পরকে দিয়ে দৈবজ্ঞ মরেন কাথা বয়ে’- তবু স্ত্রীকে সান্তনা দিতে বলিলাম- এই রকম নীতিহীন শিক্ষক হইতে আমার মেয়ে কি শিখিবে?
(ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেয়া)