আইসিইউ রোগীদের সম্পর্কে দুটি প্রশ্ন, কিছু বিভ্রান্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা

ডা. আসিফ উর রহমান
2023-12-07 17:08:50
আইসিইউ রোগীদের সম্পর্কে দুটি প্রশ্ন, কিছু বিভ্রান্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা

আইসিইউ রোগীদের সম্পর্কে দুটি প্রশ্ন, কিছু বিভ্রান্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা (ইনসেটে ডা. আসিফ উর রহমান)

আইসিইউ রোগীর নিকটাত্মীয়দের দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন , কিছু বিভ্রান্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা :-

প্রশ্ন ১:

‘স্যার আমার রোগী লাইফ সাপোর্ট মেশিনে আছে ….. কিন্তু রোগী তো নড়াচড়া করে না! আমার তো মনে হয় রোগী আর বাঁইচা নাই!'

উত্তর :

খুব সতর্কতার সাথে লক্ষ্য করুন-

একজন রোগী যখন নিজে নিজে আর কোন অবস্থাতেই শ্বাস নিতে পারেন না অথবা রোগীর ধমনীর রক্ত পরীক্ষা (arterial blood gas analysis) করে যখন দেখা যায় যে, রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতির পরিমাণ এতোটাই বেশি যে অক্সিজেনের এই ঘাটতিজনিত কারণে রোগীর মস্তিষ্ক, হৃৎপিন্ড, কিডনী সহ সংবেদনশীল অংগগুলো যে কোন মুহূর্তেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে– তখন একজন আইসিইউ বিশেষজ্ঞ/চিকিৎসক রোগীর শ্বাসনালি দিয়ে একটি নল ঢুকিয়ে (Endotracheal tube) দেন এবং রোগীকে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস মেশিনের সাথে সংযুক্ত করেন। রোগীর শরীরের অক্সিজেনের এই ঘাটতি, ventilator নামক মেশিনটি পূরণ করার চেষ্টা করে।

এক্ষেত্রে চিকিৎসকগণ রোগীর ফুসফুসসহ পুরো শরীরকে অবশ/paralyzed করে দেন এবং রোগী যাতে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকেন এজন্য কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ প্রয়োগ করেন। এসব ওষুধ রোগীকে মানসিক চাপমুক্ত রাখে, রোগীকে নিস্তেজ রেখে ফুসফুসের অক্সিজেন প্রবাহ নিশ্চিত করে এবং রোগীকে ব্যাথামুক্ত রাখে। এই সময় রোগী নড়াচড়া করতে পারেনা। ডাকলেও সহজে সাড়া দেয় না।

কতক্ষণ রোগী এভাবে নিস্তেজ থাকবে তা রোগীর ফুসফুসের উন্নতিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর নির্ভরশীল।

এ সময় রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেরই ভুল ধারণা জন্মায় ‘যেহেতু রোগী আর নড়ছে না, ডাকলেও শুনছে না, রোগী মৃত।

আশা করি বিষয়টা নিয়ে কিছুটা ধারণা দিতে পেরেছি।

বাস্তবিক অর্থে ভেন্টিলেটর মেশিন বা কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস মেশিনের বিভিন্ন mode /প্রয়োগ কৌশল অনেক জটিল বিষয়।

প্রশ্ন : ২

‘আমার রোগীর হাত পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে, শরীর কালো হয়ে গেছে। আর আপনারা ওনার গলায় ছিদ্র করেছেন/বগলে ছিদ্র করেছেন/বুকের উপরে ছিদ্র করেছেন! আমি নিশ্চিত আমার রোগী মৃত!'

উত্তর :

একজন রোগী যখন blood pressure/শরীরের রক্তচাপ নিজে নিজে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, (due to shock of any cause) তখন রোগীর মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহও কমতে থাকে। রোগী আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যায়, হৃৎপিণ্ডের রক্ত সঞ্চালন বা pumping ক্ষমতাও হ্রাস পেতে থাকে, শরীরের শিরা উপশিরা সংকুচিত হয়ে আসে (peripheral vesoconstriction)।

এমতাবস্থায় রোগীর হাত পায়ের শিরা উপশিরায় যদি ছিদ্র করা হয় ইনজেকশন বা জরুরী ওষুধ দেয়ার জন্য, অধিকাংশ সময়েই শিরায় রক্ত পাওয়া যায় না (শিরার সংকোচনজনিত কারণে)।

এ কারণেই রোগীকে বাঁচানোর জন্য চিকিৎসকরা রোগীর বগলে, গলার ডান বা বাঁ পাশে, বুকের উপরাংশে, উরুতে ছিদ্র করেন। কারণ এখানকার শিরাগুলো রোগীর blood pressure অনেক কমে গেলেও সহজে সংকুচিত হয় না।

রোগীর প্রেসার বা রক্তচাপ কমে গেলে হাত পায়ের শিরার দ্রুত সংকোচন (vesoconstriction) জনিত কারণে রোগীর শরীর মৃতের শরীরের মতোই ঠান্ডা হয়ে যায়।

অন্যদিকে রোগীর হৃৎপিন্ড, মস্তিষ্ক, কিডনী, লিভারসহ গুরুত্বপূর্ণ অংগের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য চিকিৎসকরা dopamine, adrenaline, noradrenaline, vesopressine জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করেন।

জীবনরক্ষাকারী এসব ওষুধ শরীরের হাত পায়ের রক্ত প্রবাহ কমিয়ে হৃৎপিণ্ডসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংগকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা করে। এক্ষেত্রে রোগীর গায়ে হাত দিলে খুবই শীতল মনে হয়, শরীর ফ্যাকাসে হয়ে যায়। রোগীর আত্মীয় স্বজন রোগীর শরীরের এই শীতলতা ও বর্ণহীনতাকে মৃতের শরীরের সাথে তুলনা করে ভুল করেন।

আস্থা রাখুন–
মনের যে কোনো প্রশ্ন চিকিৎসককে বলুন।

(বি: দ্র: আমি অত্যন্ত সহজ ও সাবলীলভাবে দুটি বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করেছি এবং ব্যাখ্যা দিয়েছি। বাস্তবিকপক্ষে আইসিইউর চিকিৎসা প্রণালীর বিষয়গুলো অত্যন্ত জটিল।)

 

লেখকঃ

Dr. Asif ur Rahman
MRCEM-UK.DA(DMC).MCPS.FIPM (India)
BCS.MBBS (SSMC)
Consultant - NINS। 


আরও দেখুন: