বাংলাদেশের মেডিকেলের ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা জুটির পতন
অধ্যাপক ডা. মো. রিদওয়ানুর রহমান এবং অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ
আমাদের দেশে একজন মানুষ অন্য জনের সফলতা সহ্য করতে পারেন না। চিকিৎসকদের মধ্যে এ প্রবনতা আরো মারাত্নক। কিন্তু এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো অধ্যাপক মোঃ রিদওয়ানুর রহমান এবং অধ্যাপক এম এ ফয়েজ স্যার। এই জুটি বাংলাদেশ তথা সারা পৃথিবীর চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে পরিমান অবদান রেখেছেন তা হয়ত আর কোন জুটি বা এককভাবে সম্ভব না। অধ্যাপক মোঃ রিদওয়ানুর রহমান স্যারের সাথে অনেক অনেক স্মৃতি আছে, আমি স্যারের সাথে প্রথম দেখার স্মৃতি শেয়ার করছি।
২০০৮ সাল, আমি তখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ট্রেনিং করি। ওখানে তখন মর্নিং সেশন সপ্তাহে ২ দিন হতো। আমি কোনদিনও কোন সেশন মিস করতাম না। একদিন একটা কেস প্রেজেন্টেশন হলো, এরপর অনেকজন অনেক আলোচনা করল, কিন্তু কেউ ফাইনাল ডায়াগনোসিস এ আসতে পারলো না। এরপর একজন ইয়াং স্যার, জ্যাকেট পরিহিত উনি গিয়ে সবার সামনে চেয়ারে বসলেন এবং বক্তব্য শুরু করলেন (আমি মনে মনে বললাম, এত সিনিয়র স্যারদের সামনে গিয়ে উনি কে এভাবে কথা বলছেন)। এরপরের সময়টা ছিল আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গল্পের কাহিনীর মত, স্যার এত চমৎকার ভাবে কেসটি গুছিয়ে সেশন শেষ করলেন যা বলার মত নয়। এরপর জেনেছি উনি অধ্যাপক মোঃ রিদওয়ানুর রহমান স্যার। এরপর থেকে স্যারের রাউন্ড হলেই দৌড় দিয়ে যেতাম।
এফসিপিএস পাস করার পর স্যারের সাথে আমার ইন্টারএকশন মূলত সর্প দংশন নিয়ে গবেষণার কাজের জন্য। স্যারের ধানমন্ডির বাসায় একবার সর্প দংশন নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের দাওয়াত ছিল, আমি সবচেয়ে জুনিয়র হিসেবে সেখানে দাওয়াত খেয়েছিলাম। স্যারের সাথে শেষ কথা হয় কিছুদিন আগে, স্যার ফোন দিয়ে বললনে- রতীন তুমি মিটিং এ আসো না কেন? তুমি তো এই গবেষণার একজন অথার।
স্যারের অকাল মৃত্যুতে কতটা কষ্ট পেয়েছি তা বলে বোঝানোর মত নয়। গতকাল ছিল স্যারের জন্য শোক সভা। এটি জুমে অনুষ্টিত হয়েছিল। রাত সাড়ে ৯ টায় শুরু হয়ে প্রায় দেড়টা পর্যন্ত চলেছে, বাংলাদেশের মেডিসিনের দিকপালরা এবং আরো অন্যান্য বিষয়ের অধ্যাপকগণ পুরো সময় অনুষ্ঠানে ছিলেন। শেষটা খুব কষ্টের ছিল। অধ্যাপক এম এ ফয়েজ স্যার সভাপতি ও সমাপনির বক্তব্য দিচ্ছিলেন, উনি বক্তব্য শেষ করার পর অধ্যাপক অনিরুদ্ধ স্যার অনুরোধ করে বলেন- স্যার আপনার কাছে বিনীত অনুরোধ আমরা আপনার কাছে অধ্যাপক, গবেষক নয়, আপনার রিদওয়ান, অধ্যাপক এম এ ফয়েজ স্যারের রিদওয়ান সম্পর্কে একটু জানতে চাই। এরপর ফয়েজ স্যার আর নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেন নাই। স্যার শুধু বলেছেন- আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই, আমি কিছু বলতে পারবো না। এর মাধ্যমে আমাদের সবাইকে ইমোশনাল করে প্রোগাম শেষ করে দেন।
একজন মানুষের জীবন তখনই সার্থক হয় যখন তার মৃত্যুতে শতশত মানুষ চোখের পানি ফেলেন। অধ্যাপক মোঃ রিদওয়ানুর রহমান স্যার এমনই একজন। মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত স্যার এদেশের মেডিকেল সাইন্স নিয়ে চিন্তা করেন। বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষা নিয়ে উনার চিন্তা-ভাবনা, যা করণীয় তা লিখে যান। এমন মানুষের মৃত্যু নেই, অধ্যাপক মোঃ রিদওয়ানুর রহমান স্যারের মৃত্যু হতে পারে না, তিনি বেঁচে থাকবেন ততদিন যতদিন মেডিকেল সাইন্স পৃথিবীতে থাকবে।
উল্লেখ্য, অধ্যাপক ডা. মোঃ রিদওয়ানুর রহমান স্যার ২৫ শে অক্টোবর সকাল ৯টায় ইন্তেকাল করেছেন।
লেখকঃ
ডা. রতীন্দ্র নাথ মণ্ডল
সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন
প্রাইম মেডিকেল কলেজ।