আরেকজন প্রফেসর রিদওয়ান আবার কবে তৈরি হবে!
প্রফেসর ডা. মো. রিদওয়ানুর রহমান
বুধবার (২৫ অক্টৈাবর) সকালে দুঃসংবাদটি শোনার পর থেকেই মনটা খারাপ হয়ে আছে। রিদওয়ান আঙ্কেল আর নেই। এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশে মেডিসিনের বরপুত্র বলা হতো প্রফেসর ডা. মো. রিদওয়ানুর রহমানকে। শুধু দেশেই না তিনি দেশের বাইরেও বেশ সমাদৃত ছিলেন। চিকিৎসক তো অনেকই আছেন কিন্তু চিকিৎসা-বিজ্ঞানী বলতে যা বোঝায় এমন হাতেগোনা কয়েকজনের মধ্যে আঙ্কেল একেবারেই উপরের সারিতে। উনার জ্ঞান-প্রজ্ঞা-বিবেচনাবোধ-র্যাশোনালিটি সবাইকে মুগ্ধ করতো।
এই তৈলশিল্পের যুগে যে কয়েকজন মানুষ স্পেডকে স্পেড বলার সাহস ও যোগ্যতা রাখতেন তাদের মধ্যে আঙ্কেল অন্যতম। উনার ছাত্রছাত্রীরা যারা উনার ক্লাস করেছেন তারা উনার ভক্ত বনে গেছেন। এতো সহজ করে এতো সুন্দর করে না-কি কেউ পড়ায় না। যারা উনার আন্ডারে ট্রেনিং করেছে তাদের তিনি আইডল হয়ে গেছেন। অসংখ্য চিকিৎসকের মেডিসিনের জগতে পায়চারি করার প্রেরণা প্রফেসর রিদওয়ান। খুব অল্পতেই মানুষকে আপন করে ফেলার এক অদ্ভুত গুণ ছিল তার। বাংলাদেশে ইনফেকশাস ডিজিজের যতোগুলো গাইডলাইন এসেছে সবগুলোর মধ্যেই চট্টগ্রামের এই কিংবদন্তির অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য।
কোভিডের ভয়াল সময়ে তিনি জাতিকে পথ দেখিয়েছেন তার আলোচনা ও গাইডলাইন প্রণয়নের মাধ্যমে। বিসিপিএস, বাংলাদেশ সোসাইটি অফ মেডিসিন ও টক্সিকোলজি সোসাইটি অফ বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তিনি কাজ করেছেন। তার প্রাক্তন কর্মস্থল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যখন তার জানাজা হয়, তার কলিগ ও ট্রেইনিরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। এমন দৃশ্য আজকাল কমই দেখা যায়।
ফেসবুকে দুর্দান্ত এক্টিভ ছিলেন তিনি। তার ফেসবুক পোস্টগুলো হাস্যরসের ছলে গহীনের ঘোর অন্ধকারকে চিহ্নিত করতো বারংবার।
আঙ্কেলের সাথে আমার দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবারই। বেশিরভাগ সময় দেখা হয়েছে ধানমন্ডি ৩-এ তার বাসায়। তার পুত্র রাইয়িকের সঙ্গে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের সুবাদে যখনই তাদের বাসায় যেতাম, আঙ্কেল দেখা করতেন। উনাকে কখনোই হাসিমুখ ছাড়া দেখা যেতো না। অসংখ্য ক্রেস্টে ভরপুর তার বাসাটি। কতো জায়গায় যে কতো সম্মানিত হয়েছেন!
দেশ-বিদেশে পরিবার ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরাঘুরি করতে পছন্দ করতেন। এবার আঙ্কেল, রাশেদা আন্টি ও রাইয়িক হাজ্জ্ব করে এসেছিলেন। কোভিড-সময়ে আমার ও রাইয়িকের লেখা করোনায় জীবন-ধরন বইটি আঙ্কেল কয়েক দফায় অনেকগুলো কপি ক্রয় করেন এবং তার সার্কেলের মানুষদের পাঠান। এটা আমাদের জন্য অনেক বড়ো স্বীকৃতি ছিল।
বাংলাদেশে উনার মতো আক্ষরিকভাবেই জ্ঞানী ও গুণী মানুষ খুব কম পাওয়া যাবে। দেশের চিকিৎসা জগতের এতো বৃহৎ ও উজ্জ্বল নক্ষত্রের প্রয়াণ ঘটলো অথচ মূলধারার মিডিয়াগুলো যেন সে খবর জানেই না! এরা পড়ে থাকে হিরো আলম নিয়ে, তামিম-সাকিবদের কোন্দল নিয়ে। আজ এক কলিগকে বলছিলাম, এমন গুণী ব্যক্তিকে রিকগনাইজ করতে যে যোগ্যতাটুকু প্রয়োজন তা বেশিরভাগ সংবাদকর্মীরই নেই। এদের বেশিরভাগের যোগ্যতা ও লেভেল হিরো আলম পর্যন্তই।
রাইয়িকের সঙ্গে প্রতিদিনই আমাদের কথা হয়। সেদিন রাতেও আমরা বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে অনেক মজা করলাম। আঙ্কেল ন্যূনতম অসুস্থও ছিলেন না। হঠাত করে কীভাবে কী হয়ে গেলো। যে হসপিটালে তিনি বহু বছর যাবত চেম্বার করে আসছেন, সে ল্যাবএইডেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। রাইয়িককে সান্ত্বনা জানানোর কোনো ভাষা নেই। আল্লাহ যেন তার পরিবারকে ধৈর্য্যধারণের তাওফিক দান করেন।
মেডিসিনের উজ্জ্বলতম এই নক্ষত্রকে আল্লাহতায়ালা জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন। আরেকজন প্রফেসর রিদওয়ান আবার কবে তৈরি হবে আমরা জানি না। আঙ্কেল বেঁচে থাকুন তার হাজার-হাজার ছাত্রছাত্রীর ভেতর দিয়ে।
লেখকঃ
ডা. মারুফ রায়হান খান
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য),
হৃদরোগ বিষয়ে ডি-কার্ড ও এফসিপিএস প্রশিক্ষণরত।