শান্তিপ্রিয় জহির ভাই মারা গেলেন সন্ত্রাসীর ছুরিকাঘাতে
সন্ত্রাসীর ছুরিকাঘাতে নিহত ডা. জহিরুল হক (ইনসেটে ডা. গুলজার হোসেন উজ্জল)
আমার জহির ভাই, আমাদের জহির ভাই আর নেই।
আজ ভোর ছটা তিরিশ মিনিটে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
জহির ভাই আমার এক ব্যাচ সিনিয়র ছিলেন। কুমিল্লার স্থানীয় বাসিন্দা ছিলেন বলে সপ্তাহের সব দিন হোস্টেলে থাকতেন না। ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হবার পর একদিন কামাল ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন- এই যে আমাদের বন্ধু জহির। কুমিল্লার লোকাল পোলা।
জহির ভাই হাসতেন। আমি উনাকে হাসিমুখ ছাড়া দেখিনাই। এই ছবিটা উনার আসল অভিব্যাক্তি ফুটিয়ে তোলেনি।
দুনিয়ার সব ঘটনাকে নিজস্ব সরস ভংগিতে পর্যবেক্ষণ করার একটা ব্যতিক্রমী ক্ষমতা ছিল উনার। হুমায়ুন আহমেদের মত সহজাত রসবোধ ছিল উনার। মজার মজার সব বাস্তব ঘটনা বলতেন। কিন্তু খুব সাধারণ ভাবে বলতেন। অথচ গভীর উইট থাকত। আমরা হেসে গড়িয়ে পড়তাম। জহির ভাইয়ের মুখে শোনা আমাদের স্যারদের মজার মজার কান্ড - আমার ক্যাম্পাস জীবনের অন্যতম সেরা আনন্দ ছিল।
জহির ভাই একজন সহজ মানুষ ছিলেন। ক্যারিয়ার নিয়ে আমরা যেভাবে ভাবতাম উনি ভাবতেন একদম তার থেকে আলাদাভাবে। নিজস্ব মৌলিক চিন্তা ছিল। এর বাইরে কোন কিছু দিয়েই প্রভাবিত হতেননা৷
এমবিবিএস পাশ করে শিশু বিষয়ে ক্যারিয়ার করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমরা তখন পাশ করে ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজের লেকচারার। ক্যাম্পাসের বন্ধু বড়ভাইরা মিলে একটা কলেজের টিচিং স্টাফ হয়েছি- এর চে আনন্দমুখর চাকরি আর হয়না। টিচারস কমন রুমে বসলে রাজ্যের সব আড্ডা৷ জহির ভাই একদিন বলল, " আমি পেডিয়াট্রিক্সে ট্রেইনিং করতেছি। তোমরা মনে কইরনা বাচ্চা কাচ্চা আমার খুব পছন্দ। গুলজার শিল্পী মানুষ৷ নারী শিশুদের প্রতি এদের আলাদা টান। আমার ঐসব নাই। বাচ্চা কাচ্চা আমার ভাল্লাগেনা। বিরক্ত লাগে। সবচেয়ে বিরক্ত লাগে কানলে। মনে হয় চটকানা দেই।" বলেই একটা শিশুসুলভ সরল হাসির এক্সপ্রেশন দিলেন।
আমি বললাম, তাইলে এই সাবজেকটে ঢুকলেন ক্যান?
চিন্তা করলাম একটা ডিপ্লোমা করব। দ্রুত বের হয়ে যাব। মেডিসিন রিলেটেড কোন সাব্জেক্টে থাকব। সার্জারি ভাল্লাগেনা৷ সেই হিসাবে পেডিয়াট্রিক্স সবচেয়ে ভাল মনে হইল। এইটাই।
এরকম ক্লিন কাট কথা বলার লোক হলো জহির ভাই।
এর মধ্যে এলাকায় জেনারেল প্র্যাক্টিস করতে শুরু করলেন। অলপদিনেই জমে গেল প্র্যাক্টিস।
একদিন বলল গুলজার তোমার টাকা পয়সা লাগলে বইল। তোমারে টাকা লাগলে টাকা দিব।
আমি বললাম "মানে কি? "
মানে আমার কিছু টাকা জমছে।
-ব্যাংকে রাখেন।
-ব্যাংকে রাখলে সূদ হবে। আমি সূদ খাবোনা।
- তাই বইলা মাইনষেরে যে টাকা দিবেন সেই টাকা ফেরত না পাইলে?
- যাদেরকে দিব, বুইঝা শুইনাই দিব।
এই জহির ভাই ডিপ্লোমাতে ঢুকলেন মাতুয়াইলে। আমি বললাম ভর্তি পরীক্ষায় যে নমবর পাইছেন আর আপনার যে ক্যালিবার অনায়াসে বিএসএমএমইউ নাহলে ডিএমসির কোর্সে ঢুকতে পারতেন।
শুনো, আমি ঝামেলা মুক্ত মানুষ। তুমি তো জানো আমি গ্যাঞ্জাম লাইক করিনা। মাতুয়াইল কুমিল্লা থেকে কাছে৷ আমি জীবনেও কুমিল্লার বাইরে যাইনাই। স্কুল, কলেজ, মেডিকেল সবই কুমিল্লা। এখানে কোর্স থাকলে এখানেই থাকতাম। মাতুয়াইলে হোস্টেল আছে। থাকার ঝামেলা নাই। আর চাইলে কুমিল্লা থেকে আসা যাওয়া কইরাও পারব।
জহির ভাই আপাদমস্তক ঝামেলা মুক্ত মানুষ। আমাদের মত এক্সপেরিমেন্ট করেন না জীবন নিয়ে। জীবনে তিনি কি চান তা স্পষ্ট। শান্তি চান। কমফোর্ট চান৷
সেই হাসিমুখের জহির ভাই শখ করেও বিসিএস দেননি৷ স্পেশালাইজেশন করে কুমিল্লার ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজে (প্রায়ভেট) ঢুকলেন এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে। সেই চাকরিও তার বেশিদিন ভাল লাগলোনা। চাকরি করার লোক আসলে তিনি না।
ততদিনে কুমিল্লায় তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় শিশু বিশেষজ্ঞ। চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফুলটাইম প্র্যাক্টিস শুরু করলেন। ঝামেলা ভাল লাগেনা বলে কুমিল্লায় পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাট কিনে একটায় থাকতে শুরু করলেন। আরেকটায় প্র্যাক্টিস।
ফ্ল্যাট নিয়েই দ্বন্দ্বের শুরু। জহির ভাইয়ের প্রতিবেশি স্থানীয় সন্ত্রাসী পাপ্পু তাকে নানাভাবে হয়রানি করতে শুরু করলো। চাঁদাদাবী থেকে শুরু করে নানারকম হয়রানি। জহির ভাইও স্থানীয় ছেলে। কাউকে পরোয়া করার লোক সে না।
জহির ভাইয়ের প্রিয় কুমিল্লা শহরে তারই বাসার লাগোয়া চেম্বারে তাক কোপালো সন্ত্রাসী পাপ্পু। শরীরের একটি গভীর রক্তনালী কেটে গিয়ে ব্যপক রক্ত ক্ষরণ হয়ে শকে চলে গেলেন। আর ফিরলেন না। আজ ভোরে ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি এই জাগতিক পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।
আমার শান্তিপ্রিয়, গ্যাঞ্জামমুক্ত জহির ভাই মারা গেলেন সন্ত্রাসীর ছুরিকাঘাতে৷ কি আয়রনি! জহির ভাই গভীর বিশ্বাসী ধার্মিক ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরতেন। আমার চোখে তিনি একজন নিষ্পাপ মানুষ। পরম করুনাময় তাঁকে পরম ভালবেসে তাঁর পাশে জহির ভাইকে রাখবেন এটাই আমার বিশ্বাস।
লেখকঃ
ডা. গুলজার হোসেন
সহকারী অধ্যাপক, হেমাটোলজি বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।