শুভ জন্মদিন ‘সিওমেক’

ডা. কামরুল হাসান সোহেল
2023-10-22 10:19:40
শুভ জন্মদিন ‘সিওমেক’

সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ (ইনসেটের বামে লেখক ডা. কামরুল হাসান সোহেল ও ডানে কলেজের লোগো)

সেই স্কুল জীবনেই যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই স্বপ্ন ছিল ভবিষ্যতে একজন ডাক্তার হবো। অবচেতন মনে স্বপ্ন বুননের শুরুটা হয়তো হয়েছিল বাংলা ২য় পত্রের রচনা অংশে "তোমার জীবনের লক্ষ্য" রচনা লিখতে গিয়ে। পড়াশোনায় আহামরি ভালো ছিলাম না কোনকালেই। তবে মা, বাবা সহ পরিবারের সবার স্বপ্ন বিশেষ করে আমার মায়ের স্বপ্ন এবং নিজের লক্ষ্য পূরণে ছিলাম অবিচল। এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর এলো আমার স্বপ্ন পূরণের সূচনালগ্নের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আমার স্বপ্ন পূরণের শুভ সূচনার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল মেডিকেল এডমিশন টেস্ট। বেশ ভালোভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না- প্রথম বার। খুব মন খারাপ ছিলো কয়েক দিন, তারপর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আবারও শুরু করলাম পড়াশোনা। অধ্যবসায়ের ফল পেলাম, ভাগ্যের শিকে ছিঁড়লো।

আমার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে প্রথম ধাপ উতরে চান্স পেয়েছিলাম সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে। সেই থেকে আমার সবচেয়ে প্রিয় হলো- আমার আলমা ম্যাটার, আমার সিওমেক।

১৯৪৮ সালে সিলেট নগরীর চৌহাট্টায় সিলেট মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর স্কুলটিকে কলেজে রূপান্তরের দাবিতে আন্দোলন হলে ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকারের আমলে এটিকে "সিলেট মেডিকেল কলেজ" নামে কলেজ পর্যায়ে উন্নীত করা হয়। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর নামানুসারে কলেজটির নাম পরিবর্তন করে ‘'সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ’ রাখে, যা সংক্ষেপে সিওমেক নামেও পরিচিত।

সিওমেকে প্রথম পদার্পণ এর দিনটি নিয়ে মনে ছিল চাপা উত্তেজনা। আমি সিওমেক-৩৬ ব্যাচ এর একজন গর্বিত সদস্য, আমাদের ওরিয়েন্টেশন হয়েছিল ২রা আগষ্ট, ১৯৯৮। যদিও অন্যান্য মেডিকেল কলেজগুলোতে আমাদের সমসাময়িক ব্যাচগুলোর ওরিয়েন্টেশন হয়ে গিয়েছিল আরো ৩/৪ মাস আগেই, এক অনাকাংখিত উত্তপ্ত বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই দেরি হয়েছিল আমাদের ব্যাচের ওরিয়েন্টেশন।

ওরিয়েন্টেশন ডে তে আমাদের তৎকালীন অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম কিবরিয়া স্যার বলেছিলেন, "তোমরা সবাই আজ এখানে এসেছ এক মহান ব্রত নিয়ে, তোমরা সবাই চিকিৎসক হয়ে মানুষকে সেবা দিতে ছড়িয়ে পরবে দেশের নানা প্রান্তে। সবাই ভালো চিকিৎসক হবে আশা করি, ভালো চিকিৎসক হওয়ার পাশাপাশি সবাই ভালো মানুষ হবে, আলোকিত মানুষ হবে। তোমাদের জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিবে সবার মাঝে, রোগীদের প্রতি যত্নশীল হবে,দায়িত্বশীল আচরণ করবে।"

সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এর রয়েছে দুইটি ক্যাম্পাস, পুরাতন ক্যাম্পাস ও নতুন ক্যাম্পাস।

সিলেট শহরের কাজল শাহ এলাকাতে নতুন ক্যাম্পাসে রয়েছে কলেজের মূল একাডেমিক ভবন, হাসপাতাল ভবন এবং ছাত্রদের জন্য রয়েছে কর্নেল জিয়া হোস্টেল, হযরত শাহজালাল হোস্টেল, শহীদ ডা. মিলন ইন্টার্ন হোস্টেল। ছাত্রীদের জন্য রয়েছে দিলরুবা বেগম হোস্টেল, শ্যামল কান্তি লালা হোস্টেল, হযরত শাহ পরান হোস্টেল এবং ইন্টার্ন হোস্টেল। নতুন ক্যাম্পাসে আরো রয়েছে- ডেন্টাল ইউনিট, আদর্শ পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিক, নিউক্লিয়ার মেডিসিন সেন্টার, সিলেট নার্সিং কলেজ।

সিলেট শহরের রিকাবি বাজার এবং চৌহাট্টা এলাকায় পুরাতন ক্যাম্পাসে রয়েছে শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ ছাত্রাবাস এবং আবু সিনা ছাত্রাবাস।

সিলেট এমওজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ এর নাম শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে রং বেরং এর নানা স্মৃতি। কিছু রঙ্গিন, কিছু বিবর্ণ স্মৃতি, সবকিছু স্পষ্ট মনে নেই, ঝাপসা হয়ে আসছে অনেক স্মৃতি।

তবে আজো আঁতকে ওঠি এনাটমির ডিসেকশন ক্লাসে এনাটমির কিউরেটর ডা. খোকন স্যারের কাছে আইটেম দিচ্ছি ভাবলে।

ডা. রফিক স্যার (স্কাই রফিক), স্যার আইটেম নেয়ার সময় আকাশের দিকে বা অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতেন বলে স্যারের নাম হয়ে গিয়েছিল স্কাই রফিক স্যার, ডা. মিনার স্যার এর কাছে আইটেম দেয়ার স্মৃতি।

এনাটমির সহকারী অধ্যাপক ডা. আয়েশা ম্যাডাম, সহকারী অধ্যাপক ডা. জাকিয়া ম্যাডাম এর কাছে প্রফের ভাইভা দেয়ার স্মৃতি। প্রথম প্রফেশনাল পরীক্ষায় ১৫২ জনের মধ্যে মাত্র ৫২ জন পাস করেছিল সেইবার প্রফে।

ফিজিওলজির সহকারী অধ্যাপক ডা. রেজিনা মুস্তারিন ম্যাডাম এর কাছে লাইন বাই লাইন ডেফিনিশন বলতে হতো। না বলতে পারলেই ফেইল নিশ্চিত ছিল।

বায়োকেমিস্ট্রির সহকারী অধ্যাপক ডা. রফিক স্যার এর ফেইস দেখে কখনোই বুঝা যেত না তিনি প্রশ্নের উত্তরে সন্তুষ্ট হয়েছেন না কি না।

বায়োকেমিস্ট্রির সহকারী অধ্যাপক ডা. এমদাদ স্যার ছিলেন যুগলদের জন্য রীতিমতো বিভীষিকা। যদি কোন কপোত-কপোতী স্যারের নজরে পরতো তাহলে তাদের জীবন ছিল দফারফা, পরীক্ষার ভাইভা বোর্ডে এক্সটার্নালদের সামনেও স্যার লজ্জা দিতেন।

কমিউনিটি মেডিসিন এর অধ্যাপক ডা. শিব্বির স্যারের ভাইভা বোর্ডে হুংকার, ডা. বাশার স্যারের কাছে এক টার্ম ফাইনাল পাস করার জন্য অগণিত বার সাপ্লি খাওয়া, ডা. মজিদ স্যারের লেকচারের সময় দুষ্টুমি ভরা উদাহরণ।

প্রফে প্যাথলজিতে পাস করাকে সহজ করার জন্য অধ্যাপক ডা. আমজাদ স্যারের অভিনব কৌশলে হাত উপরের দিকে তুলে বা নিচের দিকে নামিয়ে বারবার বলা বাড়ে না কমে, বাড়ে না কমে?

লিখতে গেলে শেষ হবে না কাকে বাদ দিয়ে কার কথা লিখবো?

মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. আহবাব স্যার, ডা. ফয়সাল স্যার, ডা. মতিউর রহমান স্যার, ডা. পাটোয়ারী স্যার, ডা. ওয়াহাব স্যার, বর্তমান অধ্যক্ষ ডা. শিশির চক্রবর্তী স্যার (তখন ছিলেন সিএ) মেডিসিন এ অসাধারণ দখল ছিল স্যারদের। সবসময়ই চেষ্টা করেছেন তাদের জ্ঞানের সবটুকু আলো আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে।

সার্জারিতে ছিলেন লিজেন্ডারি অধ্যাপক ডা. মীর মাহবুবুল আলম স্যার, ডা. ডি এ হাসান স্যার, ডা. সায়েক আজীজ স্যার, ডা. জুলকিফল স্যার, ডা. সালেহীন স্যার, ডা. শাখাওয়াত স্যার, ডা. দাউদ স্যার, নিউরোসার্জারিতে ডা. শেখ সাদের হোসেন স্যার, অর্থো-সার্জারিতে ডা. কামরুল আলম সালেহ স্যার, ডা. পার্থ সারথী সোম স্যারদের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম।

গাইনিতে ছিলেন অধ্যাপক ডা. আনোয়ার ম্যাডাম, অধ্যাপক ডা. হেনা ম্যাডাম, ডা. শাহানা ম্যাডাম এর মতো প্রথিতযশা গাইনিকোলজিস্ট। ম্যাডামদের ভয়ে তটস্থ থাকতো ব্যাচমেট মেয়েরা, প্রফে অনেক ভালো পেরেও মেয়েরা ফেল করতো, ছেলেরা তার চেয়ে অনেক কম পারলেও পাস করে যেত ম্যাডামদের বোর্ডে।

এমবিবিএস এর মতো টাফ একটা বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে অনেকেই মেডিকেল কলেজের স্ট্রেসফুল লাইফ এর সাথে এডজাস্ট করতে পারেনা। মেডিকেল কলেজ লাইফে আমাদের স্ট্রেস রিলিফের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিলো খেলাধুলা। স্পেশালি ক্রিকেট, কখনো কখনো ফুটবল, ভলিবল ও খেলতাম আমরা।

শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ ছাত্রাবাস এর দুই ডরমেটরির মাঝখানের পিচঢালা রাস্তায় ক্রিকেট খেলতাম প্রতিদিন বিকেলে, ছুটির দিনগুলোতে সকাল, দুপুর, বিকেল। স্পিনের ভেলকিতে এক ম্যাচে ৩ রানে ৫ উইকেট নিয়েছিলাম আমি।

আবু সিনা ছাত্রাবাসে আয়োজিত সিক্স এ সাইড ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ৩৬ তম ব্যাচের পক্ষে ৩৮ তম ব্যাচের সাথে এক ম্যাচে স্পিনের ভেলকিতে ৭ রানে ৫ উইকেট নিয়েছিলাম। নতুন ক্যাম্পাসের পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের পাশের মাঠে ক্রিকেট খেলতাম।
আন্তঃব্যাচ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হতো, আন্তঃব্যাচ ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো।

এছাড়া ছিল নানা সাংস্কৃতিক সংগঠন, যেমন- প্রতিবেশী নাট্যগোষ্ঠী, ঐতিহ্য ইত্যাদি। প্রতিবেশী নাট্যগোষ্ঠীর আয়োজনে আব্দুল্লাহ আল মামুনের "মেরাজ ফকিরের মা" মঞ্চ নাটকের একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম।

সিওমেক ডে-তে মিস করি প্রিয় সিলেট শহরকে, মিস করি কীন ব্রিজ কে, মিস করি মালনিছড়া চা বাগান কে, মিস করি প্রাণের ক্যাম্পাস কে, মিস করি আমার আলমা ম্যাটার কে, মিস করি আমার গুরুজনদের, মিস করি আমার ব্যাচমেটদের।

কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া সহকারী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. মো: মঈন উদ্দিন, অধ্যাপক (সার্জারী) ডা. মীর মাহবুবুল আলম স্যার, অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি) ডা. গোপাল শংকর দে স্যার, তানজানিয়ায় তাবলীগ জামাতের দাওয়াতী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে শাহাদাৎ বরণকারী সহপাঠী ডা. গোলাম সামদানী, এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির জটিলতায় মৃত্যুবরণকারী সহপাঠী ডা. মিম্মি সহ সবার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

সিওমেক ডে-তে এটাই প্রত্যাশা ভালো থাকুক আমার আলমা ম্যাটার, ভালো থাকুক প্রাণের সিওমেক, ভালো থাকুক সিওমেক-এর সবাই। 

লেখকঃ

ডা. কামরুল হাসান সোহেল
সিওমেক-৩৬ ব্যাচ
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য),
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বরুড়া, কুমিল্লা। 


আরও দেখুন: