যে শিক্ষক আমাকে সম্মোহিত করেছিলেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো
নটরডেম কলেজের প্রয়াত অধ্যক্ষ ফাদার বেনজামিন ডি কস্তা (ইনসেটে ডা. আসিফ উর রহমান)
আমি তখন নটরডেম কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। ফাদার বেনজামিন ডি কস্তা তখন প্রিন্সিপাল।
আমি খুব ঘরকুনো টাইপের ছেলে ছিলাম, সারাক্ষণ মায়ের পিছে পিছে ঘুরতাম! সেই আমি মায়ের শাড়ির আঁচলে ভাত খেয়ে হাত মুছা ছেলেটা ঢাকা শহরে এলাম। মেসে থাকি!
কেও নেই, কাওকে চিনিনা! কি নিষ্ঠুর শহর! কেও কারো খোঁজ খবর রাখেনা। তিনবার টাইফয়েড জ্বর হলো। মেসে কাথা মুড়িয়ে শুয়ে থাকি, বাথরুমের দরজা আটকিয়ে কাঁদি!
কলেজের ক্লাস ভালোলাগে না.......... সারাদিন দূরের আকাশে তাকিয়ে থাকি।
২০০০ সাল, মোবাইলও নেই যে, মায়ের সাথে একটু কথা বলবো! এভাবে কেটে গেলো চারমাস!
কুইজ পরীক্ষা দিতে পারিনা, মন বসেনা পড়াশোনায়। নটরডেমের মাঠের উপরে ক্লাস বাদ দিয়ে ভরদুপুরে বসে থাকি!
একদিন বসে বসে দূর্বাঘাস চাবাচ্ছি, রেজাল্ট দিয়েছে। ফিজিক্সে পেয়েছি ১০০ তে ৩০! পড়ালেখাই তো করিনা!
হঠাৎ মাথায় স্নেহের স্পর্শে উপরে তাকিয়ে দেখি ফাদার বেনজামিন ডি কস্তা হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করছেন- 'কি হয়েছে বাবা! মন খারাপ? তোমার ক্লাস নেই? রোদের মধ্যে মাঠে বসে আছো কেনো?'
আমি চুপ করে মাথা নিচু করে বললাম- 'আমি বাড়ি যাবো ফাদার! মায়ের কাছে! আমি নটরডেমে পড়বো না।'
ফাদার বেনজামিন নিজ হাতে আমার ব্যাগটা মাটি থেকে তুলে নিলেন! মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন-
‘সবসময় মা বাবা ছায়া দিতে পারেন না বাবা .........
জীবনে একসময় নিজে নিজে পথ চলতে হয় ........
যাও ঘুরে আসো, পাঁচদিনের ছুটি নিয়ে যাও। তুমি বলছো নটরডেমে পড়বে না!
কতো লক্ষ ছেলে নটরডেম কলেজে পড়ার স্বপ্ন দেখে তুমি কি জানো? খোঁজ নিয়ে দেখো, তোমার বাবা হয়তো বাসে চড়ে তোমার পড়ার খরচ যোগাচ্ছেন!
তোমার মেধা নিয়ে তোমার তো সন্দেহ থাকার কথা নয় বাবা! তুমি পারবে। যাও ঘুরে আসো মায়ের কাছ থেকে।'
সেদিন একজন শিক্ষকের, অধ্যক্ষের মোটিভেশনাল স্পিচ আমাকে সম্মোহিত করেছিলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো।
কলেজ জীবন কেটেছে ..........
গ্রাজুয়েশন জীবন কাটিয়েছি .......
পোস্ট গ্রাজুয়েশনও ..........
খুব কম শিক্ষক মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চেয়েছেন ছাত্রের বুকে কি কষ্ট !
খুব কম শিক্ষক মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছেন -
'সবসময় মা বাবা ছায়া দিতে পারেন না বাবা .........
জীবনে একসময় নিজে নিজে পথ চলতে হয় ........
তোমার বাবা মা কতো স্বপ্ন নিয়ে তোমার দিকে চেয়ে আছেন, হয়তো জানো না!
খোঁজ নিয়ে দেখো, তোমার বাবা হয়তো বাসে চড়ে তোমার পড়ার খরচ যোগাচ্ছেন!
আমি যদি কোনো দিন শিক্ষক হই- আমি ফাদার বেনজামিনের মতো শিক্ষক হতে চাই। আমি আমার ছাত্রদের সাথে মিশে যেতে চাই, স্নেহের পরশ বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করতে চাই - ‘বাবা! কি সমস্যা? আমাকে কি খুলে বলা যাবে?’
সৃষ্টিকর্তা ওপারে আপনাকে ভালো রাখুন ফাদার বেনজামিন!!
লেখক :
DR. ASIF UR RAHMAN
MRCEM-UK.DA.MCPS.
FIPM- India.
MBBS, BCS (Health).
Consultant- NINS Emergency Medicine,
Intensive Care Medicine Specialist.