প্রফেসর ডা. মো. বেলাল উদ্দিন স্যার যেসব কারণে অনন্য
প্রফেসর ডা. মো. বেলাল উদ্দিন স্যারের সঙ্গে লেখক ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব
গতকাল (৩০ সেপ্টেম্বর) প্রফেসর ডা: মোহা: বেলাল উদ্দিন স্যার তার সরকারী চাকুরী জীবনের ইতি টানলেন। যদিও পূর্বেই পিআরএলে থাকা অবস্থায় স্যার বারিন্দ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেছেন।
গতকাল ব্যতিক্রম কিছু হল। সাধারণত এমন দিনে যিনি অবসর নেন তার জন্য অফিসের সবাই একটা প্রোগ্রামের আয়োজন করে। কিন্ত গতকাল হল উল্টো। গতকাল স্যার নিজেই একটা প্রোগ্রামের আয়োজন করলেন। আসলে শিশু বিভাগের পক্ষ থেকে স্যারকে নিয়ে একটা বড় প্রোগ্রামের আয়োজন করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্ত স্যার বলেছিলেন," তোমরা না আমিই তোমাদের ইনভাইট করব।" গতকাল লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে বর্তমান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সকল ডাক্তার আর স্যারের ট্রেইনি যারা আমার মত মেডিকেলের বাইরে আছে তাদের জন্য বড় একটা খানাপিনা প্রোগ্রামের আয়োজন করলেন। হোস্ট হয়ে গেল গেস্ট। আর গেস্ট হয়ে গেল হোস্ট। একারণে স্যার একটু ব্যতিক্রম, একারণে স্যার অনন্য।
স্যার গতকাল মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তার জীবনের সংগ্রামের গল্প শোনালেন। সফলতার মাঝে লুকিয়ে থাকা কষ্টের কাহিনী বললেন। আবেগ লুকিয়ে রাখা মানুষটিকে এই প্রথম সবাই কাঁদতে দেখল। স্যারের জীবনের একটা অজানা চ্যাপ্টারের কথা সবাই জানতে পারল।
স্যারের জীবনের অনেক গল্পের নীরব শ্রোতা আমি। কারণ দীর্ঘদিন আমি স্যারের ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্ট্রারের দায়িত্বে ছিলাম। স্যার রাউন্ড দিতেন। স্যার রাউন্ডে রোগী দেখা আর পড়াশোনার পাশাপাশি নাতিদীর্ঘ গল্প বলতেন। সেই গল্পে থাকত স্যারের মেডিকেল জীবনের গল্প, স্যারের শিক্ষকদের গল্প, স্যারের এফসিপিএস পরীক্ষার গল্প, পরিবারের গল্প। সব গল্পেই শিক্ষনীয় কিছু থাকত।
অভিভাবকের আসনে বসে স্যার শিশু বিভাগটিকে গড়ে তুলেছিলেন একটা সুখী পরিবারের মত। সবাই যেন আত্মার আত্মীয়। ডিপার্টমেন্টে আমাদের রিফ্রেশমেন্টের জন্য টুকটাক এ প্রোগ্রাম, ও প্রোগ্রাম লেগেই থাকত। বিশেষ দিন আর বর্ষণমুখর দিনে আমাদের সঙ্গী হত খিচুড়ি, ডিম, হাঁসের মাংস আর আলুর ভর্তা।
আমরা ট্রেইনি ডাক্তাররা এমনিতেই ওয়ার্ডে ছুটতাম। এমনিতেই ওয়ার্ডে পড়ে থাকতাম। কারণ আমাদের ঘোড়সাওয়ার ছিলেন আমাদের চেয়েও বেশি দ্রুতগামী। স্যার আমাদের ওয়ার্ডে পড়াতেন। রাউন্ড শেষে আবার তার রুমে পড়াতেন। একটু কম সিরিয়াস আর কম পড়ুয়া স্টুডেন্টকেও বাধ্য হয়ে পড়তে হত, ওয়ার্ডের এ মাথা থেকে ও মাথা ছোটাছুটি করতে হত। স্যার আমাদেরকে সারা বছরই বিভিন্ন পরীক্ষায় ব্যস্ত রাখতেন। এফসিপিএস, এমডি, ডিসিএইচ আর এমসিপিএস পরীক্ষার জন্য স্যার তার নিজ হাতে স্টুডেন্টদের তৈরী করতেন, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতেন। এ রকম একজন সেনাপ্রধানের পিছনে যুদ্ধ করতে কারও ভয় পাওয়ার কথা নয়। স্যারের শত ব্যস্ততার মাঝে তার ছাত্র-ছাত্রী ছিল ফার্স্ট প্রায়োরিটি। ডুবন্ত একজন স্টুডেন্টকে টেনে তুলে আনার অসাধারণ এক ক্ষমতা স্যারের আছে।
মা-বাবা যেমন তার সন্তানের ভাল রেজাল্টে আনন্দিত হয় স্যারও ঠিক তেমন আনন্দিত হতেন। আমাদের যে কোন ভাল রেজাল্টে স্যারের মুখমন্ডলের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হয়ে যেত। স্যারের শিশু সুলভ হাসিটা তখন আরও সুন্দর দেখাত। সে সময় স্যারের হাঁটা চলাফেরার ধরনেরও যেন একটা পরিবর্তন দেখা যেত। আমরা যারা বিভিন্ন কোর্সে ছিলাম তারা পরীক্ষার আগে ভাবতাম এই মানুষটির মুখে একটি সুন্দর হাসি দেখার জন্যই আমাকে পাশ করতে হবে। স্যারের মুখের হাসিটাই তখন আমাদের মুখ্য হয়ে ওঠে। মনে হত যদি পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করি তাহলে হয়ত আমাদের চেয়ে স্যার-ই বেশি কষ্ট পাবেন। এ কারণে তখন আমরা সর্বোচ্চ স্পিডে দৌড়াতে থাকতাম।
স্যার আমাদের অনেক শ্রদ্ধার একটা জায়গা। স্যার পিরামিডের চূড়ায় বসে থাকা এক শিক্ষক। এখনও আমরা স্যারের সামনাসামনি বসতে অস্বস্তি বোধ করি। স্যারের দিকে এখনও আমরা পুরোপুরি চোখ তুলে তাকাতে পারি না।
স্যার যখন গতকাল বক্তব্য দিতে দিতে চোখের পানি ফেলছিলেন, তখন আমরাও নিজের শার্টের হাতলে চোখ মুছছিলাম। আমরা আমাদের প্রতিটি ভাল রেজাল্টের পর কাঁদতে কাঁদতে স্যারকে মোবাইল করতাম। আমরা মোবাইলের এপারে আনন্দে কাঁদতে থাকতাম। আর স্যার মোবাইলের ওপারে প্রশান্তি নিয়ে হাসতে থাকতেন।
কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায়, বিনয়, অন্যকে উৎসাহিত করা, অন্যকে সম্মান দেয়া, কৃতজ্ঞতা বোধ, সবাইকে সমান চোখে দেখা, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি গভীর ভালবাসা- এইসব অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রফেসর বেলাল উদ্দিন স্যার অনেক উঁচু পর্যায়ের একজন শিক্ষক। তিনি আসলে শিক্ষকদের শিক্ষক। তিনি তার প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর মা-বাবার পাশের আসনে বসতে পারা একজন মানুষ।
প্রফেসর বেলাল উদ্দিন স্যার কখনও অবসরে যেতে পারেন না। শুধু তার কর্মস্থলের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র, কর্মের নয়। স্যারের সামনের সময়টি আরও সুন্দর আর প্রানবন্ত হবে এই দোয়া আমরা করি।
(স্যারের সাথে আমার অনেক ছবি থাকলেও ভাল কোন ছবি নেই। কারণ ছবি তোলার পর দেখেছি প্রতিটি ছবিতে স্যার আর আমার মাঝে একটা বেশ বড় গ্যাপ থাকে। আসলে স্যারের প্রতি আমার বেশি মাত্রার শ্রদ্ধার কারণে স্যারের খুব কাছাকাছি যেতে পারি না, শরীর ঘেঁষে দাঁড়াতে পারি না। তবে কেন জানি গতকাল প্রোগ্রামে তোলা ছবিটিতে সেই গ্যাপটা ছিল না।)