শিশুর প্রধান পাঠশালা পরিবার
শিশুর প্রধান পাঠশালা পরিবার (ইনসেটে ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব)
হাসপাতালের মর্নিং রাউন্ডে আছি। আমার সাথে একজন মেডিকেল অফিসার আর দুইজন নার্স। এই মুহূর্তে যে বেডের সামনে দাঁড়িয়ে আছি সে বেডে ছয় বছর বয়সী একটি বাচ্চা শুয়ে আছে। বাচ্চার সাথে বেডে বসে আছে বাচ্চার মা আর একটু ভাল স্বাস্থ্যের নানী। আমরা বাচ্চাটির খোঁজ খবর নিচ্ছি, বাচ্চাটিকে দেখছি। তারপরও মা আর নানী ঠাঁই বিছানায় বসে আছেন।
আমি সচরাচর কাউকে এমন কথা বলি না যাতে সে লজ্জা পায়। তারপরও খুব ভদ্রভাবে বাচ্চার অল্প বয়সী মাকে লক্ষ্য করে বললাম, "আপনারা দুইজন বেড থেকে নামুন।" তারা সুন্দরভাবে বেড থেকে নেমে এল।
আমি মুখে একটু হাসি নিয়ে বললাম, "আপনাদের বাড়িতে কেউ বেড়াতে গেলে আপনারা কি করেন? একটু উঠে এসে বরণ করে নেন নিশ্চয়। আর এখানে চারজন মানুষ আপনাদের বাচ্চাকে দেখতে এসেছেন আর আপনারা বেডে বসে পান চর্বণ করছেন। আপনাদের বেড থেকে নামতে বললাম এ কারণে যে, আপনার ছোট্ট মেয়েটি এই দৃশ্যটি আজ দেখল। ও যখন বড় হবে তখন এই ঘটনা মনে রাখবে। ও বড়দের সাথে কখনও এরকম ব্যবহার করবে না।"
আপনি আজ যা করছেন আপনার সন্তানও বড় হয়ে তাই করবে। আপনি বাড়িতে বসে বিড়ি টানলে আপনার ছেলেও বড় হয়ে একদিন বিড়ি টানবে। বিড়ির লেটেস্ট ভার্সনের (মদ,গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল) সাথে বন্ধুত্ব তৈরী করবে।
আপনি টিভি সেটে বাচ্চাদের সামনে হাফ প্যান্ট পড়া নায়িকার অশ্লীল নৃত্য দেখলে সেও বড় হয়ে অশ্লীল কাজ করবে। আজ প্রগতিশীলের ব্যানারে ফ্যামিলিতে অশ্লীলতাকে সাপোর্ট করছেন, একটা সময় সে বড় হয়ে পাংকু টাইপের কারও হাত ধরে অজানার পথে পাড়ি জমাবে। মুখে তার থাকবে," তুমি আর আমি। আর কেউ নয়। এমন একটা যদি পৃথিবী হয়।" কারণ খুব ছোট্ট বয়সেই আপনি তার লজ্জা ভেঙে দিয়েছেন।
সন্ধ্যার পর বাড়ির সকলেই গোল বৈঠক বসিয়ে অন্যের পরনিন্দা করেন, অন্যের নেগেটিভ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন আর হাসাহাসি করেন। দেখবেন আপনার সন্তানও বড় হয়ে বিশিষ্ট সমালোচক হবে। অন্যের সমালোচনা করবে। অন্যের পজিটিভ দিক খুঁজে পাবে না। যা খুঁজে পাবে তা সবই নেগেটিভ। আপনার সন্তান নেগেটিভ মেন্টালিটি নিয়ে বড় হতে থাকবে।
সারাদিন স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াঝাটি, একে অন্যকে ব্লেমিং করা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সংসারে কখনও সম্পূর্ন সুস্থ মানসিকতার সন্তান তৈরী হয় না।
নিজের মা-বাবার সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলেন। শ্বশুর-শাশুরী আর আত্মীয়-স্বজনদের বোঝা মনে করেন। বাড়ির কাজের মানুষের সাথে মিসবিহ্যাব করেন। বড় হয়ে আপনার সন্তানও তাই করবে। ও একটা সময় আপনার সাথে উচ্চবাক্য করবে। আপনার কথা শুনবে না। নিকট আত্মীয়দের উটকো ঝামেলা মনে করবে।
আপনার মেজাজ খুব চড়া। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সবাইকে বকাবকি করেন।
আপনি একটা আতঙ্কের নাম। আপনি সর্বদা " মেরে দিয়ে ডান্ডা, করে দিব ঠান্ডা"- এই মেজাজে চলাফেরা করেন। আপনি আসলে নিজের অজান্তেই আপনার সন্তানের মধ্যে রূঢ়তা আর হিংস্রতার বীজ বুনে দিচ্ছেন। সেও একটা সময় বদমেজাজি হবে। অন্যদের ডান্ডা দিয়ে ঠান্ডা করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকবে।
আপনি আজ অন্যের পকেট কাটছেন। তাল্টিবাল্টি করে বুকের সিনা টান করে হাঁটছেন। একটা সময় আপনার সন্তানও দুই নাম্বারি করে অন্যের পকেট কাটবে। এই লাইনে আপনার চেয়েও সে বেশি খ্যাতি অর্জন করবে।
সন্তান তার মা-বাবাকে অনুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে দেখে। আপনি নিজেও বোঝেন না আপনার পাঁচ বছরের শিশুটিও আপনাকে মার্কিং করে।
পরিবারের ভিতরের পরিবেশ সুন্দর আর পবিত্র না করে বাচ্চাদের যতই ধর্মীয় পাঠশালায় ভর্তি করান না কেন নিট ফলাফল খুব ভাল হবে না। আগে পরিবারের মানুষদের সংশোধন হতে হবে। আগে পরিবারের শান্তির জন্য লড়তে হবে। তারপর বাইরের পরিবেশ।
আপনাকে দেখেই আপনার সন্তান বিনয়ী হবে। আপনার কাছ থেকেই সে সত্য কথা বলতে শিখবে। আপনার কাছেই সে লজ্জার শিক্ষা পাবে। আপনার কাছ থেকেই সে ভাল ব্যবহার শিখবে। আপনার কাছ থেকেই সে বডি ল্যাংগুয়েজ রপ্ত করবে, কথা বলার ধরণ শিখবে। আপনার শিক্ষাতেই সে অন্যকে সন্মান দিতে শিখবে। আপনার শিক্ষার মাধ্যমেই সে উন্নত রুচিশীল মানুষে পরিণত হবে। আপনার শিক্ষাতেই সে জীবনকে সঙ্গায়িত করবে। বিপরীতে খারাপটাও শিখতে পারে।
পরিবার-ই একটি শিশুর প্রধান পাঠশালা। এই পাঠশালার শিক্ষা দিয়েই তার মনুষ্যত্বের ভিত তৈরী হয়।