ব্লাড ক্যান্সারের বাচ্চাদের প্রতি দুর্বলতা ও আমার পরীক্ষাভাগ্য

ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব
2023-09-08 16:08:06
ব্লাড ক্যান্সারের বাচ্চাদের প্রতি দুর্বলতা ও আমার পরীক্ষাভাগ্য

ব্লাড ক্যান্সারের বাচ্চাদের প্রতি দুর্বলতা ও আমার পরীক্ষাভাগ্য (ইনসেটে লেখক)

২০২১ সালের মাঝামাঝি। এমসিপিএস পরীক্ষায় লিখিত পাশ করার পর ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সকাল ৮ টার মধ্যেই আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে পৌঁছে গেলাম। আজ পাশ করলেই এমসিপিএস ডিগ্রি হয়ে যাবে।

প্রথমে একটি লং কেস পরীক্ষা, তারপর চারটি শর্ট কেস পরীক্ষা। সবশেষে মৌখিক পরীক্ষা। সব মিলিয়ে আলাদা আলাদা আটজন পরীক্ষককে ফেইস করতে হয়। তবে পরীক্ষার শুরুটা অর্থাৎ লং কেস একটু ভাল হলে পরেরগুলো ভাল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। শুরুটা ভাল হলে এমনিতেই কনফিডেন্স বেড়ে যায়।

লং কেস অনেকটা লটারির মত। কার ভাগ্যে কি পড়বে তা আগে থেকে কেউ অনুমান করতে পারে না। তবে যে যে বিষয়ে একটু বেশি এক্সপার্ট সে বিষয় পড়ে গেলে পরীক্ষা অনেকটা সুবিধা হয়। যেমন আমার সবচেয়ে পছন্দের বিষয় "ব্লাড ক্যান্সার"। আমি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনেক ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় জড়িত ছিলাম।

ভাগ্যগুণে আমার কপালে লং কেস পড়ল ব্লাড ক্যান্সারের শিশু। শুধু কি তাই ? সেই বাচ্চাটি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের আমার ওয়ার্ডেই ভর্তি ছিল। সাতদিন পূর্বেই নিজ ইচ্ছায় রাজশাহী থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছে। আমি নিজেই তার চিকিৎসা করেছি। কাকতালীয়ভাবে সেই বাচ্চার উপরেই আমার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। লং কেস বেশ ভাল হল। কনফিডেন্স বেড়ে গেল। পরীক্ষার পরের স্টেপগুলোও ভাল হল। এমসিপিএস পরীক্ষায় পাশ করে গেলাম।

২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়। এবার এফসিপিএস পরীক্ষা। লিখিত, OSPE & IOE পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সবশেষ ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় পাশ করলেই একাডেমিক পরীক্ষার ইতি ঘটবে। এ পরীক্ষায় পাশ করলেই পাশের জন্য আর কোনদিন পড়তে হবে না। উত্তেজনায় জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার পূর্ব রাতটা কাটল পুরোপুরি নির্ঘুম অবস্থায়।

একটানা চব্বিশ ঘন্টা না ঘুমিয়ে সকাল আটটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম পরীক্ষার কেন্দ্রে।

কাকতালীয়ভাবে আবার সেই পরীক্ষার কেন্দ্র পূর্ব পরিচিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। কাকতালীয়ভাবে আবার লং কেস ব্লাড ক্যান্সার। লং কেসের পরীক্ষা বেশ ভাল হয়ে গেল। কনফিডেন্স বেড়ে গেল। পরীক্ষার পরের অংশগুলোও ভাল হয়ে গেল। সব মিলিয়ে পাশ করলাম। স্বপ্নের এফসিপিএস ডিগ্রিটা অর্জন করলাম।

যখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এফসিপিএস ট্রেইনি ছিলাম তখন ব্লাড ক্যান্সারের বাচ্চাদের জন্য সবচেয়ে বেশি ছুটতাম। ওদের চিকিৎসার সব স্যার-ম্যাডামদের থেকে টাকা তুলতাম। কখনও কখনও চিকিৎসার অর্থের জন্য ডিরেক্টর স্যারের কাছে ছুটতাম। কোন বাচ্চা খুব খারাপ হয়ে গেলে নামাজে তার জন্য দোয়া করতাম। বাসায় ফিরে আম্মুকে দোয়া করতে বলতাম। কোন বাচ্চা মারা গেলে বাসা আশেপাশে হলে জানাযার নামাজে এটেন্ড করার চেষ্টা করতাম।

এই বাচ্চাগুলো আমাকে এভাবে ফিডব্যাক দিবে তা আমি কখনও ভাবিনি। জীবনের সবচেয়ে স্ট্রেসফুল দুইটি পরীক্ষায় এভাবে আমার স্ট্রেস কমিয়ে দেবে তা কখনও চিন্তা করিনি। আসলে আল্লাহ আমার পরীক্ষাকে সহজ করে দেওয়ার জন্য পরীক্ষার কেন্দ্রে ওদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

এ ধরনের পরীক্ষায় যারা পাশ করেছেন তাদের সবারই একটা আলাদা আলাদা গল্প আছে। তবে আমার গল্পটা এরকম। স্বর্গ থেকে যেন কিছু নিষ্পাপ শিশু এসে অদৃশ্যভাবে আমার হাত দুটো ধরে জীবনের সবচেয়ে কঠিন দুটো পরীক্ষা পার করে দিয়ে গেছে।

আমি এখনও কিছু মৃত শিশুর স্পর্শ অনুভব করি। শীতল, কোমল, পবিত্র এক স্পর্শ।

 

লেখক :

ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব
জুনিয়র কনসালট্যান্ট, পেডিয়াট্রিক্স
উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স, পত্নীতলা, নওগাঁ।


আরও দেখুন: