রোগীদের এই আস্থা-বিশ্বাসই চিকিৎসক হিসেবে আমার অনুপ্রেরণা

ডা. আশরাফ জুয়েল
2023-08-09 12:07:25
রোগীদের এই আস্থা-বিশ্বাসই চিকিৎসক হিসেবে আমার অনুপ্রেরণা

দিনের পর দিন এই ক্রিটিকাল রোগীদের নিয়ে কাজ করতে একটুকুও ক্লান্তি লাগেনি (ইনসেটে লেখক)

চিকিৎসক হিসেবে আমার অর্জন হয়ত কিছুই নেই। তবু আমি বারবার চিকিৎসক হিসেবেই জন্ম নিতে চাই।

পাশ করার পর থেকেই কাজ করছি আইসিইউ-তে। তাও প্রায় উনিশ বছর৷ বারডেম থেকে আরম্ভ করে দুইটা কর্পোরেট ঘুরে এখন বিআরবি হাসপাতালে।

২০০৫ সালে যখন প্রথম বারডেম আইসিইউ-তে ঢুকি মনে হয়েছিলো এ বুঝি কোনো কল্পচিকিৎসাবিজ্ঞানের জগৎ। মেশিনপত্রে ঝুলে আছে মানুষের জীবন। খুব ভালো লেগে যায়- প্রথম দিন যে প্যাশন নিয়ে কাজ আরম্ভ করেছিলাম, নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি আজও সেই প্যাশন এতোটুকুও কমেনি।

দিনের পর দিন এই ক্রিটিকাল রোগীদের নিয়ে কাজ করতে একটুকুও ক্লান্তি লাগেনি, আজও লাগে না।

প্রায় মাস খানেক আগে ক্যান্সার আক্রান্ত এক রোগী সেপসিস নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন আইসিইউ-তে। দিন দশেক পরে ট্রানস্ফার হয়ে ওয়ার্ডে যান। রোগীর অনুরোধে মাঝেমধ্যে কেবিনে গিয়ে তাঁকে আনঅফিশিয়ালি দেখে আসতাম। এক সময় তিনি বাসায় চলে যান। বারবার বুকে পানি জমে যাবার জন্য বুকে একটা পাইপ বা পিগ টেইল লাগিয়ে দিয়েছিলাম, যেন তিনি চাইলেই বুকের জমা পানি বের করে নিতে পারেন।

বাসায় গিয়েও মাঝেমধ্যে ছোটখাটো প্রবলেম হলে কল দিয়ে পরামর্শ নিতেন।

অজ্ঞান অবস্থায় পুনরায় তিনি হাসপাতালে আসেন, এবার কার্বনডাই অক্সিজেন রিটেনশন। নন-ইনভ্যাসিভ ভেণ্টিলেটর দিয়ে ম্যানেজ করা হয় এবং বাই-প্যাপসহ আবারও বাসায় পাঠানো হয়।

দিন দশেক পর আবারও আসেন হাসপাতালে। এবারও আনকনসাস, সিও টু ১১৫ বা এরও কিছু বেশী। হাসপাতালে নন-ইনভ্যাসিভ ভেন্টিলেটর দিয়ে ম্যানেজ করা হচ্ছে এখনো।

যতবার উনার সামনে গিয়েছি, প্রতিবারই উনার হাসিমুখ দেখেছি। তীব্র শ্বাসকষ্টের মধ্যেও তার মুখ থেকে হাসি হারিয়ে যায়নি। প্রতিবার অবাক হয়ে ভেবেছি, একটা মানুষ এতো কষ্টের মধ্যেও হাসেন কীভাবে! আল্লাহর কাছে তার জন্য দোয়া করেছি আর মহান আল্লাহতা'আলার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি, তিনি এখনো আমাদের সুস্থ রেখেছেন এবং অসুস্থ মানুষের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। মাঝে মাঝে আমার হাত ধরে তিনি বলতেন ডাক্তার সাহেব আমাকে বাঁচান, আমি বাঁচতে চাই! আমার বাচ্চা দুইটা ছোট... ওদের জন্যই আমাকে বাঁচতে হবে... আমি আশ্বাস দিতাম, বলতাম, ইনশাআল্লাহ আপনি সুস্থ হবেন। কিন্তু জানতাম, এ রোগ তো সারার না...

আজ উনার অবস্থা বেশ খারাপ। যেকোনো সময়ই কার্ডিয়াক এরেস্টে যাবার সম্ভাবনা। ডিএনআর/ডিএনআই দেয়া। জ্ঞান আছে, মাঝেমধ্যে অলটারড। উনার বড় ভাই আমাকে ডেকে একটা কাগজ দেখালেন। অনুরোধ করলেন, আমি যেন রোগীর অনুরোধে 'না' না করি।
কাগজটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখ ভিজেও এলো। রোগীর ভাই আমার হাত ধরে রোগীর শেষ ইচ্ছাটা রাখার জন্য অনুরোধ করলেন।

একটা চিরকুটে কাঁপাকাঁপা হাতে তিনি লিখেছেন, আমাকে যেন ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়, এবং আমি যেন আমার ইচ্ছেমতো এই টাকাটা খরচ করি এবং যেন তার হাসপাতালের বিল হিসেবে এ টাকা দেয়া না হয়৷

আমার কোনো না-ই তিনি শুনলেন না। রোগীর মাথায় হাত দিয়ে এই টাকা আমি নিতে পারব না এ কথা জানালাম। কিন্তু তিনি অনড়। ইশারায় বারবার অনুরোধ করলেন। রোগীর ভাইও বললেন, এটা আমার ভায়ের শেষ ইচ্ছে, আপনি না করতে পারবেন না।

রাজী হলাম। রাজী হলাম এই শর্তে যে, এই টাকার পুরোটা আমি কোনো মসজিদ-মাদ্রাসায় রোগীর নামে দিয়ে দেব বা কোনো গরীব রোগীর চিকিৎসায় ব্যয় করব।

তিনি শান্ত হলেন। রুমে ফিরে চুপচাপ বসে থাকলাম। চোখের দুই কোন ভিজে উঠলো অজান্তেই।

আল্লাহপাক আমাদের সকলকে সুস্থ করে দিন। সকলের সমস্ত গুনাহকে নেকীতে রুপান্তরিত করে দিন। সকলকে রোগমুক্ত করুন, রোগীর সকল কষ্ট দূর করে দিন। আমীন।

চিকিৎসক হিসেবে আমার প্রতি রোগীদের এই বিশ্বাস/আস্থা- এই অর্জনগুলোই আজীবন আমার জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

লেখক :

ডা. আশরাফ জুয়েল
চিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক।
কনসালটেন্ট, আইসিইউ ও ইমার্জেন্সি, বিআরবি হাসপাতাল।


আরও দেখুন: