বিপদে চিকিৎসক সমাজ
কী এক বিপদে যে আছে চিকিৎসক সমাজ (ইনসেটে লেখক)
একজন রোগীকে বাড়ি থেকে গড়িমসি করতে করতে হসপিটালে আনার পথে মারা গেলো। কিংবা ধরি বাড়িতেই মারা গেলো। তারা না-কি টেরই পায়নি কখন রাতে মারা গেছে। কারণ কেউই এই অসুস্থ মানুষটার পাশে রাতে ছিল না, সবাই বেঘোরে ঘুমিয়েছে। এই যে মারা গেলো, দোষী কে? কেউ দোষী না, কারও বিরুদ্ধে মামলা নেই, কাউকে মারধোর নেই, সাংবাদিকদের বিশাল বিশাল নিউজ নেই, পুলিশ এসে গ্রেফতার করে জেলে ভরে রাখা নেই। সবাই বলাবলি করবে, "হায়াত ছিল না আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন। হায়াত-মউতের উপর কারও হাত নেই। সবারই একদিন মারা যেতে হবে।"
এবার দৃশ্যপটটি ভিন্ন আঙ্গিকে কল্পনা করি। এই বয়স্ক রোগীটিই। ভোরে প্রচণ্ড বুকে ব্যথা উঠেছে। সকালে গ্রামের টিনের ছাপড়া দিয়ে বসা হাতুড়ে ফার্মেসি দোকানদার প্রফেসরকে ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে। সে এসে বলল, আরে এটা তো গ্যাশটিকে টান মাইচ্ছে। গ্যাশটিকের ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। সকাল গড়িয়ে বিকেল ব্যথা তো কমে না। আরেকটু দেখে। মাথায় পানি দেয়। পা মালিশ করে। কমে না। রাত ৮ টা। একজন বলল, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এবার। কে নিয়ে যাবে? এক ভাই বলছে তুই হসপিটালে নিয়ে যা, আরেক ভাই বলছে, আমি পারব না, আমার কাজ আছে, তুই যা।
এমন গড়িমসি করতে করতে ভোরে ওঠা বুকে ব্যথার রোগীকে রাত ১০.৩০ টায়--একদম ক্রিটিক্যাল অবস্থায় কোনোরকমে হাসপাতালের বারান্দায় এনে ফেললো। চিকিৎসক-সেবিকা দ্রুত কিছু ইনজেকশান দিলেন, অবস্থা খুবই খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে চিকিৎসক বুক জোরে জোরে চেপে সি পি আর দেওয়া শুরু করলেন। না, বাঁচানো গেলো না--আল্লাহ আয়ু রাখেননি আর।
এবার দৃশ্যপটটি আরও গভীরভাবে কল্পনা করি। আমার রোগী একটু আগেও পানি খেতে চেয়েছে, একটু আগেও কথা বলেছে, একটু আগেও শ্বাস নিয়েছে। ইনজেকশান দেওয়ার পরপরই আমার রোগী মারা গেছে। এই ডাক্তার বুক চেপে আমার রোগী মেরে ফেলেছে। যে ভাইরা তুই নে, তুই নে বলেছে হসপিটালে আনার সময়-- সে ভাইয়েরা তো বটেই আরও ১৫-২০ জন জুটে গেছে। চিকিৎসকের কলার চেপে ধরবে। প্রহার করবে। সাংবাদিকগণ রোগীর স্বজনদের অভিযোগ শুনে বড়ো বড়ো হাইলাইটেড নিউজ করবে--ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু। চ্যানেলগুলো বাড়তি কাটতির আশায় বারবার দেখাবে এই সংবাদ। রোগীর তালতো ভাইয়ের নাতনি জামাইয়ের ফুপাতো ভাইয়ের ভাগ্নেও একটা বিবৃতি দেবে। কেউ কেউ আবার থানায় কেস করবে। ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করবে। পুলিশ শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে এসে গ্রেফতার করবে সেই চিকিৎসককে। মাসের পর মাস জেলে কাঁদবে। পরিবার-পরিজন উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটোছুটি করেও জামিন নিতে পারবে না। তার অন্য চিকিৎসক কলিগরা এর প্রতিবাদে কর্মবিরতি দিলে, "অসহায় রোগীদের জিম্মি করে চিকিৎসকদের দাবি আদায়। ডুকরে কাঁদছে মানবতা। মানবতা আজ কোথায়?"
কী এক বিপদে যে আছে চিকিৎসক সমাজ, এরা কাউকে বোঝাতেও পারে না। এরা সবার চোখেই অপরাধী। এরা যে যাবে কোথায় এর উত্তর কেউই জানে না আসলে।
লেখক :
ডা. মারুফ রায়হান খান
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য),
হৃদরোগ বিষয়ে ডি-কার্ড ও এফসিপিএস প্রশিক্ষণরত।