আমাদের সেবার মানসিকতা নষ্ট করে দিয়েন না
আমাদের সেবার মানসিকতা নষ্ট করে দিয়েন না (ইনসেটে লেখক)
১. গর্ভবতী মহিলা ভর্তি হলেন অবসটেট্রিক্স ওয়ার্ডে। ডেলিভারি হলো। যে বাচ্চাটি জন্ম নিলো সে স্বাভাবিক সময়ের অনেক আগেই জন্ম নিলো, লো বার্থ ওয়েট- মাত্র ১.৫ কেজির মতো ওজন। বাচ্চার অবস্থা বিশেষ ভালো না। নিবিড় পরিচর্যা অতি প্রয়োজন, তাকে পাঠানো হলো NICU-তে ভেন্টিলেটরে। এটি যেহেতু একটি প্রাইভেট মেডিকেলের ঘটনা, জেনে থাকবেন- ICU তে অনেক খরচ। আর ওদিকে অবসটেট্রিক্স ওয়ার্ডে ভর্তি বাচ্চার মা। এবার আপনার অবাক হবার পালা। মা একটু সুস্থ হবার পর রোগীর লোকেরা মাকে নিয়ে কেটে পড়লেন, বাচ্চাকে ফেলে! হ্যাঁ, বাচ্চা তখনও NICU-তে, আর উনারা পগারপার!
NICU তে দায়িত্বরতরা বাচ্চার এটেন্ড্যান্ট না পেয়ে বারবার ফোন দিতে লাগলেন উনাদেরকে। হয় উনারা ফোন ধরেন না, নয়তো এই যে আমরা আসছি, অমুক জায়গায় আছি- এসব বলেন। এভাবে কেটে গেলো প্রায় এক মাস। অবশেষে বাচ্চার মায়ের চন্দ্রমুখ দেখা গেলো। বাচ্চাকে নিয়ে যেতে হলে তো হসপিটালের এতদিনের বিল পরিশোধ করে যেতে হবে। বিল হয়ে গেছে এতোদিনে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। উনাদের কাছে কোনো টাকা নেই। বাচ্চাকে কীভাবে নিয়ে যাবেন? ইন্টার্ন ডক্টররা একসাথে বসলেন। কী করা যায়। বাচ্চাটার জন্য তাদের গভীর মায়া জন্মেছে ততদিনে। চাঁদা তুলে তারা জোগাড় করলেন ৪০/৫০ হাজার টাকা। ছোট করে দেখবেন না, ইন্টার্ন ডাক্তারের বেতন আপনার প্রাইভেট কারের ড্রাইভারের চেয়েও ৫০০০-৭০০০ টাকা কম। এবার তারা গেলেন হসপিটালের ডিরেক্টরের কাছে- বিলটা যদি একটু কানসিডার করেন। অবশেষে প্রায় ১ লক্ষ টাকা মাফ করিয়ে ঐ টাকাতেই বাচ্চাটাকে রিলিজ করা হলো। ঘটনা শুনে কেউ আবার বলে বোসেন না- মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি!
২. আমরা ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এক জুনিয়র ডাক্তার হাতে কয়েকটা টাকার নোট এবং পাশে এক লোককে নিয়ে আমাদের কাছে এলেন। ঐ লোকের মা মারা গিয়েছেন, দাফন-কাফনের টাকা নেই। আমরা যেন হেল্প করি। যে যা পারি দিলাম। এভাবে তিনি তার বিভিন্ন কলিগদের কাছে যেয়ে যেয়ে টাকা তুলছেন। তিনি একজন ধনীর দুলালী- সব সঙ্কোচ ভুলে হাত পাতছেন, এমনকি জুনিয়রদের কাছেও! এটা কোনো বিচ্ছিন্ন কিংবা অস্বাভাবিক ঘটনা না। মানুষ আন্দাজে একটা কথা বলে দিলো সেটা শুনেই গলাবাজি না করে একটু হসপিটালে ঘুরুন- এরকম আরও অনেক কিছুই দেখতে পাবার কথা। আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধব প্রায়ই এ ধরনের কাজ করেন।
৩. অনেকটা দুঃখের সাথেই বলতে হয়, বাচ্চা প্রসবকালীন সময়ে যে প্রসূতির রক্ত লাগা খুবই স্বাভাবিক এবং এজন্য আগে থেকে রক্তদাতা ম্যানেজ করে রাখা উচিত- বেশিরভাগই হয়তো জানেন না, জানলেও হয়তো মানেন না। সে যাহোক, ওটির টেবিলে যখন পেশেন্টের রক্ত প্রয়োজন হয়, রোগীর লোকদের বলা হয়, রক্ত খুঁজে পান না তারা। সাধারণত রক্তের গ্রুপ মেলে না, রক্তের গ্রুপ মিললে তারা নাকি খুবই দুর্বল, স্বাস্থ্য ভালো না, ভয় পান ইত্যাদি- বাধ্য হয়ে ডাক্তাররাই খোঁজ করেন রক্তের। কখনও সহকর্মীদের, কখনও জুনিয়রদের ফোন করে ব্যবস্থা করেন রক্তের। কখনও নিজে ডিউটিতে থাকা অবস্থাতেই ডাক্তাররা রক্ত দেন অহরহ। রক্ত দিয়ে এসে ঐ পেশেন্টের সার্জারিতেই এসিস্ট করেছি৷ গাইনিতে গভীর রাতে ডিউটির মাঝেই শোচনীয় অবস্থার রোগীকে রক্ত দিয়ে এসে ডিউটি করেছি। খুব কম ডাক্তারই বোধহয় আছেন যারা এরকমভাবে রক্ত ম্যানেজ করে দেন না বা নিজের রক্ত দেন না পেশেন্টদের। এগুলো তাদের জন্য বড় কোনো ইস্যু না।
৪. ডাক্তার সাহেবকে একটা ওষুধ কোম্পানি এসে কিছু স্যাম্পল দিয়ে গেলেন। তিনি গ্রহণ করলেন। একটু পর নার্সকে ডেকে বললেন অমুক বেডে ওষুধগুলো দিয়ে আসুন- গরীব মানুষ ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই। প্রাপ্ত বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ অনেক ডাক্তারই দিয়ে দেন অসহায় রোগীদের। আমাদের কতো বন্ধুরা স্যাম্পল চেয়ে নিয়ে যান, টাকা নিয়ে যান অসহায় রোগীদের জন্যে সেসব বলতে যাবার মানে হয় না। সত্যি কথা। কতো ডাক্তার যে তার প্রেসক্রিপশনে ২৫%/৩০%/৪০% ছাড় লিখে দেন তার ইয়ত্তা নেই। আমাদের অনেক শিক্ষক আছেন যাদের কাছে ১০ জন রোগী এলে ৩-৪ জনকেই ফ্রি দেখতে হয়, কখনও আরও বেশি। কতো চিকিৎসক রোগীর অবস্থা দেখে ভিজিট নেবেন আর কী নিজেই উলটো তাকে টাকা দিয়ে দিয়েছেন ওষুধ আর টেস্ট করাবার জন্যে- সে গল্প কি খুব অজানা? রূপকথা নয়।
৫. প্রসববেদনা উঠেছে রাত ১০টায়। লেবার রুমে আনা হয়েছে যে কোনো সময় ডেলিভারি হবে। পৌনে ৪টার দিকে ডেলিভারি হলো। পুরো সময়টাতে দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি বাচ্চার অপেক্ষায়, মাঝে মাঝে পাশে একটু টুলে বসেন...
৬. অন্যদের কথা বাদ দিই। আমার বন্ধুদের কথায় আসি। তখন থার্ড ইয়ারে নতুন নতুন সার্জারি ওয়ার্ড করা শুরু করেছি। স্যার একটা পেশেন্ট দেখাতে নিয়ে গেলেন— তার ফিকাল ফিস্টুলা ডেভেলপ করেছে। রোগী স্যারের হাত বড় নির্ভরতার সাথে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলেন— "সার আমি ভালো হব তো? গরীব মানুষ আমরা স্যার।" স্যার আশ্বাস দিয়ে এলেন ঠিকই, পরে আমাদের ডেকে শোনালেন হৃদয়বিদারক কথাটা। সম্ভাবনা খুব একটা ভালো না। রোগীটির যে জটিলতা— তাতে তাকে মুখে খাবার দেওয়া যাবে না। শিরার মধ্য দিয়ে পর্যাপ্ত পানি, ইলেক্ট্রোলাইটস, খুব প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো তরলাকারে সরবরাহ করতে হবে। চার সপ্তাহ যদি তাকে এভাবে সাপোর্ট দেওয়া যায় তাহলেই তার সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা । প্রচুর খরচ এতে, অনেক বেশিই বলা চলে। যদি দিতে না পারা যায়, তাহলে এ পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। ২য় বারেও মেয়ে সন্তান হওয়ায় উনাকে ফেলে নাকি চলে গিয়েছে তার পাষণ্ড স্বামী, বাবাও জীবিত নেই। স্যার বললেন, দেখো তোমরা কিছু করতে পারো কিনা।
এর আগের দিনই আমাদের কলেজে পিঠা উৎসব ছিল। যে টাকা প্রফিট হয়েছিল, সেটা দিয়ে আমরা একটা পার্টি দেব ভেবে রেখেছিলাম। সাথে সাথে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলো— যা টাকা সবাই মিলে ইনভেস্ট করেছিলাম এবং যা লাভ হয়েছে সব দিয়ে দেব উনার ট্রিটমেন্টের জন্য। শুধু তা না, এর পরদিন থেকে সব ক্লাসমেটরা যে যেভাবে যেখান থেকে পেরেছে টাকা জোগাড় করে একসাথে জমা করেছে। আমাদের টিচাররা ওষুধ কোম্পানির সাথে কথা বলে কম দামে ওষুধের ব্যবস্থা করেছেন। এভাবে প্রায় ৩ মাস ধরে চললো তার ব্যয়বহুল চিকিৎসা। অপারেশান হলো। কোনো টাকাই তার কাছে ছিল না। রিলিজের দিন সবাই মিলে গেলাম হসপিটাল ডিরেক্টরের কাছে। অনেক কম টাকা ব্যয়ে তাকে রিলিজ করা হলো। এতো টাকা উঠেছিল যে, পুরো চিকিৎসার পরেও আমাদের কাছে আরও টাকা থেকে গিয়েছিল। যাবার সময় সে টাকাটা আমরা দিয়ে দিলাম যাতে কিছু করে খেতে পারে।
৭. এক খুবই অসহায় রোগী। অনেক জটিল অপারেশানের প্রয়োজন। টাকার অভাবে করাতে পারছে না। তিনি বেতনের ৩০০০০ টাকা পাবার সাথে সাথে পুরোটাই ওদের হাতে তুলে দিয়েছেন। ঐ ডাক্তার আমাকে বলছিলেন, "আমি জানি না সারা মাস কীভাবে চলব...শুধু জানি তার অপারেশান করাতে হবে।" সেই চিকিৎসক বর্তমানে ময়মনসিংহ মেডিকেলে কর্মরত একজন কার্ডিওলজিস্ট।
লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে। নাহয় আরও অনেক গল্প বলা যেতো৷ এই ঘটনাগুলো কিন্তু বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। প্রতিটি মেডিকেলে প্রতিদিন অহরহ এমন ঘটনা ঘটছে। চিকিৎসকরা প্রচারবিমুখ বলে তারা এসব বিষয় খুব একটা সামনে আনেন না। নিজেদের ভালো লাগার জায়গা থেকে, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এসব করেন।
অন্য দেশের মতো ক্ল্যাপ না দিলেন, ওভেশান না দিলেন, হেলিকপ্টার দিয়ে ফুল-বৃষ্টি না ঝরালেন--অন্তত মারধোর করেন না৷ নিজের বিবেকের কাছে, নিজের পরিবারের কাছে খুব লজ্জা লাগে। শরীরের ব্যথা মুছে যায়। মনের ব্যথা যে বোঝে না...আমাদের সেবার মানসিকতাগুলো আপনারা নষ্ট করে দিয়েন না...
লেখক :
ডা. মারুফ রায়হান খান
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য),
হৃদরোগ বিষয়ে ডি-কার্ড ও এফসিপিএস প্রশিক্ষণরত।