জরুরী চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে
জরুরী চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে (ইনসেটে লেখক)
শুক্রবার রাত ৯টা বাজে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরতে হবে। ক্লান্তিতে চোখ খুলে রাখায় দায় হয়ে গেছে। এমন সময় একজন মা তার ছেলেকে নিয়ে চেম্বারে হাজির। মায়ের মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ভয়ে কথা বলতেই পারছেন না। ছেলেটা খুব অসুস্থ হয়ে গেছে। তার হাত-পা ধনুকের মত বেঁকে যাচ্ছে। একজন চিকিৎসক আমার কাছে পাঁঠিয়েছেন। মাকে বাচ্চার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিতে পাচ্ছেন না, ভয়ে ও শংকায়।
কোন ওষুধ খাইয়েছেন কিনা, জানতে চাইলে শুধু নাপা সিরাপের কথা বলছেন।
আমি কিছুতেই মেলাতে পারছি না। শুধু নাপা খাওয়ালে তো এমন হওয়ার কথা না।
আবার বলছেন মাথায় আঘাত পেয়েছে। তাও মিলছে না।
কি করব চিন্তা করছি। রেফার্ড করে দিবো কিনা ভাবছি।
কিন্তু মায়ের যে অবস্থা এখন ঢাকা বা কুমিল্লায় নিতে বললে জ্ঞান হারাতে পারেন।
অনেকক্ষণ সময় ধরে জিজ্ঞেস করছি অন্য কোন ওষুধ খাইয়েছেন। কিন্তু একি উত্তর, নাপা সিরাপ।
কিছুক্ষণ পর ওদের বাড়ি থেকে আনা সব জিনিসপত্র ঢেলে খুঁজছি কোন ক্লু পাই কিনা। ১ বছর আগের একটা প্রেসক্রিপশন পেলাম।
যে ওষুধটি আমি খুঁজছি সেটার নাম লেখা।
মাকে জিজ্ঞেস করলাম এ প্রেসক্রিপশনের ওষুধ খাইয়েছেন। তিনি মাথা নাড়ালেন।
এবার আমি থামলাম। রোগ নির্ণয় করে ফেললাম। এসব করতে করতে ২০ মিনিটের বেশি সময় চলে গেছে।
রোগের চিকিৎসায় ইনজেকশন দিতে হবে। ইনজেকশন আনতে বললাম। রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে আমি কখনো ভয় পাই না। কারণ আমি শতভাগ নিশ্চিত আমি রোগীর ক্ষতি করছি না।
ইনজেকশন আনার পর নার্সকে বললাম দিয়ে দিতে। হঠাৎ কি মনে হলো নার্সকে না করলাম। নার্স ভড়কে গেলো। আমাকে এমন দোটানায় দেখে নাই কখনো।
আমি বেশ ভয় পেয়েছি। ইনজেকশন দিলে যদি কিছু হয়ে যায়। বেশ ভয় লাগছে। এমন ভয় আগে কখনোই হয়নি। রোগীর স্বজনরা আবার মারধর করবে না তো? মনে মনে ভাবলাম, কুমিল্লা বা ঢাকায় পাঠিয়ে দেই।
ছেলেটার দিকে তাকালাম। খুব মায়া লাগলো। মা অঝোরে কান্না করছে। বাবা বিদেশ থেকে বারবার ফোন করছে।
আল্লাহর উপর ভরসা করলাম। নার্সকে বললাম, ইনজেকশন দিতে। আমার হার্টবিট বাড়ছে। অথচ এমন রোগীকে অনেকবার এমনে ইনজেকশন দিয়েছি। কখনোই এমন হয় নাই।
ইনজেকশন দেয়ার আধা ঘন্টার মধ্যে ছেলেটা সুস্থ হবে তাও জানি। পুরোটা সময় চেম্বারেই বসে থাকলাম। ছেলেটা সুস্থ হলে ঢাকায় রওনা দিলাম।
রাত ২ টায় ফোন করে খবর নিলাম। সুস্থ আছে জেনে নিশ্চিত হলাম।
আমি যদি বাচ্চাটাকে চিকিৎসা না দিয়ে ঢাকায় রেফার্ড করতাম তাহলে ওদের কি কষ্টটাই না হতো। আমিও অপরাধবোধে ভুগতাম। এখন বারবার ছেলেটার হাসিমুখ ভাসছে। কিন্তু তখন ছেলেটা কথা মনে হলেই অপরাধী মনে হতো।
চিকিৎসকদের মাথায় মামলা হামলার ভয় থাকলে সুচিকিৎসা করা সম্ভব নয়। এতে ক্ষতি হবে আমাদের সবার।
লেখক :
ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু
সহকারী অধ্যাপক
ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস।