রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য এ এক অশনি সংকেত

ডা. বাহারুল আলম
2023-07-13 12:43:38
রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য এ এক অশনি সংকেত

ঝুঁকির কারণে ‘বিপর্যস্ত জরুরি চিকিৎসা’ থেকে ক্রমেই চিকিৎসকরা নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে (ইনসেটে লেখক)

ঝুঁকির কারণে ‘বিপর্যস্ত জরুরি চিকিৎসা’ থেকে ক্রমেই চিকিৎসকরা নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে- রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য এক অশনি সংকেত। 

চিকিৎসা বিপর্যয়ে রাষ্ট্র সংবেদনশীলতায় দায়িত্বশীল না হলে এই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে চিকিৎসকদের দায়িত্ব পালন অসম্ভব হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও জনগণ কারও কাছ থেকেই চিকিৎসা বিপর্যয়ে যখন চিকিৎসকরা আইন থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তা ও দায়মুক্তি পায় না, তখন নিজেরা আর বিপর্যস্ত জরুরি চিকিৎসার সাথে যুক্ত হতে চাচ্ছে না।

এর প্রেক্ষিতে বিনা চিকিৎসায় অসংখ্য রোগী মারা যাবে। অথচ রাষ্ট্রের সরকার ও প্রশাসন এ বিষয়ে নির্বিকার। জরুরি চিকিৎসায় সফলতার বিপরীতে ব্যর্থতাও থাকতে পারে– এই ব্যর্থতাকে ফৌজদারি অপরাধ গণ্য করে পুলিশ ও বিচারিক আদালত শাস্তি দেওয়ার যে আচরণ প্রদর্শন করছে, তাতে গোটা চিকিৎসক সমাজ আতংকিত। এ বিষয়ে সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য বিষয়ক সংসদীয় কমিটি, প্রশাসনিক দপ্তর ও মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর– চিকিৎসককে কোন প্রকার নিরাপত্তা দিতে নারাজ। তাদের প্রয়োজন কেবল বায়োমেট্রিক ফিঙ্গার প্রিন্ট। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনে করে আঙ্গুলের ছাপই যথেষ্ট। চিকিৎসককে নিরাপত্তা দেওয়া ও নিরাপদে না রাখলে জরুরি চিকিৎসার অভাবে অসংখ্য রোগীর মৃত্যু ঘটবে– এ বিষয়টি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মস্তিষ্কে নাই অথবা বিনা চিকিৎসায় মানুষ মরে গেলে বা অঙ্গহানি ঘটলে এসব কর্তাব্যক্তিদের জবাবদিহি করতে হয় না।
আগেও বলেছি, এখন আবারও বলি- আনএথিক্যাল কাজের জন্য চিকিৎসককে শাস্তি দিতে বিএমডিসি সদা তৎপর। কিন্তু যখন চিকিৎসকের উপর রাষ্ট্রের আনএথিক্যাল খড়গ নেমে আসে তখন বিএমডিসি রাষ্ট্র ও তার প্রশাসনের সাথে এই নিয়ে লড়াই করে না। অথচ ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসার ব্যর্থতায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, বিচার বিভাগ আক্রমণ করলে চিকিৎসকরা রাষ্ট্রের কোন সংস্থার কাছে যাবে- সে বিষয়েও বিএমডিসি কিছু বলে না!

বিএমডিসি দাবী করে সাংবিধানিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত। বাস্তবে রাষ্ট্র ও সরকারের তাঁবেদাররা সেখানে অবস্থান করছে। সে কারণেই অপরাধ না করেও চিকিৎসক জেলখানায় গেলে বিএমডিসি বলে না।

বাংলাদেশের উপজেলা থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অসংখ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত চিকিৎসকরা মোকাবেলা করছে ‘বিপর্যস্ত জরুরি চিকিৎসা’র সাথে। কেউ বেঁচে যাচ্ছে, চিকিৎসা ব্যর্থতায় কেউ বা মারা যাচ্ছে। জরুরি চিকিৎসায় শতভাগ রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে বা বেঁচে যাবে– চিকিৎসা বিজ্ঞানে এরূপ স্বীকৃত নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অক্ষমতা বা ব্যর্থতায় কিছু রোগী মারা যেতে পারে– সে ব্যর্থতার দায় চিকিৎসকের নয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের। কিন্তু রাষ্ট্র মনে করে– চিকিৎসকই এর জন্য দায়ী।

জরুরি চিকিৎসার সাথে যদি চিকিৎসকরা আর যুক্ত না হতে চায় তখন সরকার কি বলবে/ করবে? চিকিৎসকের জন্য সংবিধিবদ্ধ দায়মুক্তি/নিরাপত্তা আইন (৮০, ৮৮) পুলিশ মানছে না। তাহলে কোন আইনের উপর ভরসা করে চিকিৎসকরা এসব ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসায় নিজেকে যুক্ত করবে? ইতোমধ্যে সেন্ট্রাল হাসপাতাল সহ দেশের অন্যান্য স্থানে সংঘটিত চিকিৎসা বিপর্যয়ে রাষ্ট্রের পক্ষে পুলিশ যে আচরণ করেছে– অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জরুরি চিকিৎসা দেওয়া হতে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে/ নিচ্ছে। অথচ সরকার থেকে এ বিষয়ে প্রতিকারের কোন উদ্যোগ নাই। সে কারণে চিকিৎসকরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিয়েছে এবং সেটা যথার্থ। ভুক্তভোগী জনগণের শেষ অবলম্বনটুকু থাকল না।

মানবিক পেশার মানুষগুলোকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখতে চায় বাংলাদেশ। চিকিৎসকদের সংগঠন ও নেতৃত্বের হঠকারিতার জন্য তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিরাপত্তার কোন স্পর্শ পেল না। রাষ্ট্র ও তার সরকার বলছে না- ‘ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসায় তোমরা নির্ভয়ে এগিয়ে যাও, আমরা আছি তোমাদের সাথে। দায়মুক্তি আইনের পুরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটাব।’

চিকিৎসকরা নিরাপদ ও নিরাপত্তায় থাকলেই রোগীরা আপদকালীন চিকিৎসা পাবে, অন্যথায় নয়।


আরও দেখুন: