সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ আমাকে ভীত করে তুলছে
সাম্প্রতিক বেশ কয়েক মাসের ঘটনাপ্রবাহ আমাকে ভীত করে তুলছে (ইনসেটে লেখক)
IsmailHossain Kochi সাহেব আমার লিস্টে আছেন।
ওনাকে ডেথ ডিক্লায়ার করার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিলো বিশেষজ্ঞ বোর্ড।
আমি তখন এফসিপিএস মেডিসিন পার্ট ২ ট্রেইনী ঢাকা মেডিকেলের, তরুণ চিকিৎসক। ওরে আমার সাহস!
কচি সাহেবের leptospirosis with uremic coma, AKI, hepatic failure, severe hyponatremia, hypo kalaemia, septic shock (MODS) হয়েছিলো। উনি লাইফ সাপোর্ট/ভেন্টিলেটর মেশিনে তখন।
GCS 3/15 ছিলো। তিনটা আয়নোট্রপ চলছিলো ওনার, লো বিপির কারণে SLED dialysis ও দিতে বারণ করেছিলো আমাকে মেডিকেল বোর্ড।
রাতে ইসমাইল হোসেন কচি সাহেবের স্ত্রী আমার সাথে আইসিইউর সামনে দেখা করলেন। সাথে ওনার ছোটো বাচ্চা ছিলো খুব সম্ভবত।
আমি ওনাকে বললাম- "মা জ্বী। আমি ডায়ালাইসিস দেবো, নিজের রিস্কে, শেষ চেষ্টা করবো। আপনি কি রাজী আছেন?"
উনি বললেন- "আপনি যা ভালে মনে করেন। আমার স্বামীকে বাঁচান।"
ক্যাথেটার করে ডায়ালাইসিস শুরু করলাম SLED, কচি সাহেব নিতে পারলেন না। SLED ফেইল হলো। ডায়ালইসিসের সময় VT VF, আমি বুক চেপে সিপিআর, শক দিয়ে ওনাকে ফেরালাম। পরের দিনই আমার উপর মেডিকেল বোর্ড চরম বিরক্তি প্রকাশ করলো, আমি আইসিইউ ডক্টর ইনচার্জ তখন।
প্রয়াত আইসিইউ কনসালটেন্ট ডা. ইউসুফ জামিল ভাই শুধু বললেন- "তুই একটা ক্রেক, আগা, জিতলে হিরো, নাইলে জিরো!"
পরের দিন আমি আবারও একই জুয়া খেললাম, আবার দিলাম ডায়ালাইসিস, আলহামদুলিল্লাহ, আমি সাকসেসফুল হলাম।
একদিন গ্যাপে আবারও দিলাম SLED.
রোগী আস্তে আস্তে চোখ খুললো। ১ মাসের মধ্যে সম্পূ্র্ণ সুস্থতা পেলেন কচি সাহেব।
ইদানিং কচি সাহেব ঢাকায় এলেই আমার সাথে দেখা করেন। বাড়ির ফলমূল নিয়ে আসেন, না করি হাজার বার, শুনেন না। ঢাকায় এলে উনি একবার হলেও দেখা করবেনই আমার সাথে।
আমি আসলে জানিনা- সেদিন কচি সাহেব মারা গেলে আমার বিরুদ্ধে রোগী হত্যার মামলা হতো কিনা! এই প্রশ্ন কচি সাহেবকে করার প্রচন্ড ইচ্ছা আমার। করিনি এখোনো।
বহুদিন পর ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে গতকাল প্রাইভেট হাসপাতালে ক্রিটিক্যাল রোগী ভিজিটের সব অনুরোধ আমি রিফিউজ করে দিলাম।
আগে রিস্ক নিতে আমার বিন্দুমাত্র ভয় লাগতো না, বহু রোগী বিভিন্ন স্থানে ভুল চিকিৎসা পেয়ে আমার শরণাপন্ন হয়েছে, এমন কি ভারতে ট্রান্সপ্ল্যান্ট হওয়া রোগীর ফুসফুস যখন CMV তে তছনছ- আমি রাত জেগে এন্টিভাইরাল দিয়ে রোগীকে মনিটরিং করেছি।
বহু ক্রিটিক্যাল রোগীর দোয়া আমার মাথার এই জটপাকা চুলে লেপ্টে আছে। আমার এই জোড়া হাতে বহু মৃত রোগীর আত্মীয় চোখের পানি ফেলে বলেছে- "আপনি দোয়া করবেন ডাক্তার সাহেব। চেষ্টা করেছেন, নিঃসন্দেহে। আমাদের দাবী নাই।"
সাম্প্রতিক বেশ কয়েক মাসের ঘটনাপ্রবাহ আমাকে ভীত করে তুলছে। আমার মস্তিষ্ক আমাকে বারবার রিস্ক বেনিফিট রেশিও হিসাব করতে বলছে, রোগীর জীবন নিয়ে আজরাইলের সাথে ডু অর ডাই ম্যাচ খেলার আগে জিজ্ঞেস করছে- "আসিফ সাহেব! আপনি আরেকটু ক্যালকুলেটিভ হন! হিরো কম সাজুন, জাস্ট একটা ব্যর্থতা আপনাকে মিডিয়া ট্রলের শিকার করাবে। আপনার ব্যক্তিগত অর্জন, সততা সব তছনছ করে দেবে। বুঝে শুনে আগান।"
ইদানিং আমি আমার পাসপোর্টের দিকেও তাকাই, কে জানি কানে ফিসফিসিয়ে বলে- "বেকুব রে! তুই তো চাইলেই লাল ব্রিটিশ পাসপোর্ট নিতে পারস।"
মুহূর্তেই আমার মায়ের চেহারা ভেসে উঠে, আকাশে মেঘ জমেছে, আম্মা পুঁইশাকের ডগা ছিঁড়তেছেন, চিংড়ি মাছ দিয়ে রান্না করে আমাকে খাওয়াবেন বলে। অথচ মা জানেন- আমি এখন ঢাকায়।
আমার বান্দরবানের পাহাড়গুলা আমাকে ডাকে ........ জিজ্ঞেস করে - "কিরে পাগলা? তুই কি আসলেই চলে যাবি আমাদের ছেড়ে?"
আমার চোখের জল গাঢ় হতে থাকে!
লেখক :
Dr. Asif ur Rahman
MRCEM-UK.DA(DMC).MCPS.FIPM-India.
FRCEM-(Final,UK).BCS.MBBS
Consultant - NINS