ভুল চিকিৎসা, মিডিয়া ট্রায়াল, পাবলিক সেন্টিমেন্ট

অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগম
2023-07-07 16:09:21
ভুল চিকিৎসা, মিডিয়া ট্রায়াল, পাবলিক সেন্টিমেন্ট

ভুল চিকিৎসা, মিডিয়া ট্রায়াল, পাবলিক সেন্টিমেন্ট (ইনসেটে লেখক)

মসি অসির চেয়েও শক্তিশালী। দু'টোরই চালককে হতে হবে আরও শক্তিশালী। মসির ব্যবহারে চালকের অভ্যন্তরীন প্রজ্ঞা, মননশীলতা, মানবিকতা, নৈতিকতা, দৈন্যতা সবকিছুই প্রকাশ পায়।

একজন সাংবাদিকের মসি সাংঘাতিক শক্তিশালী। সত্য যেমন উদঘাটন হয় তেমনি একটি মিথ্যাকেও সত্যে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়। সাংবাদিকের কলমের খোঁচায় জনমত গঠন হয়। কখনও ইতিবাচক, কখনও নেতিবাচক। বিশেষ করে চিকিৎসকদের ব্যাপারে একটু নেগেটিভ কিছু লিখলেই জনসাধারনকে খুব সহজেই ক্ষেপিয়ে তোলা যায়। তাতে খবরের কাগজের কাটতি বাড়ে এবং তারা লাভবান হয়। চিকিৎসা বিষয়ক খবরগুলো পরিবেশনের আগে সাংবাদিকদের এ বিষয়ে পড়ালেখা করা উচিত। যদি বলেন ওটি আমাদের বিষয় নয় তাহলে ঐ বিষয়ে খবর পরিবেশন করাও আপনাদের বিষয় নয়।

গাছের কান্ড দিয়ে স্টেম সেল থেরাপি দেয়া হয়, এই হেডলাইনে খবর করা সাংবাদিক যখন কোন চিকিৎসককে নিয়ে লিখবে তখন কি লিখতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

ভুল চিকিৎসা কাকে বলে? চিকিৎসায় কোনটা ভুল কোনটা সঠিক সেটা বলার অধিকার কোন সাংবাদিক রাখে কি? এটি বলার জন্য ঐ বিষয়ের এক্সপার্ট দরকার। যেমন সার্জারীর বা মেডিসিনের হাইলি এক্সপার্ট লোকও গাইনী অবসের চিকিৎসা ভুল কিনা বলার এখতিয়ার রাখে না। গাইনী অবসও অন্য বিষয়ের বেলায় বলার এখতিয়ার রাখেনা। এমনকি গাইনী অবস এর কোন বিশেষায়িত বিষয়ের কাজের ভুল অন্য কোন গাইনোকলজিস্ট বলার অধিকার রাখেনা। কেননা অন্যদের বিষয়গুলোতে তাদের সম্যক জ্ঞান ও পারদর্শীতা নেই।

সেখানে কথায় কথায় ভুল চিকিৎসা বলে সাংবাদিকরা বহু চিকিৎসকের মান হানি করেছেন, হয়রানি করেছেন। সাংবাদিকদের কাজ সঠিক তথ্য তুলে ধরে মানুষের উপকার করা। তাদের কলমের জোরে মানুষ তার ন্যায্য অধিকার ফিরে পাক, ন্যায় বিচার পাক, ন্যায্য চিকিৎসা পাক, কিন্তু ন্যায্য চিকিৎসা দেবার পরেও চিকিৎসক সন্মান না হারাক, হয়রানীর শিকার না হোক।

সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটিতে সাংবাদিকদের একতরফা খবর প্রকাশে তারা যে জনরোষ তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে তারই ফলাফল নির্দোষ দু'টি মেয়ের জেলবাস ও জামিন না মঞ্জুর করা,এবং শুধু নির্দোষীই নন যিনি পেশেন্টের জীবন রক্ষা করেছেন তাকে জামিন না দেয়া।

কি সেই মিডিয়া ট্রায়াল? ডেলিভারী করাতে গিয়ে পায়খানা ও প্রস্রাবের রাস্তা কেটে ফেলা। কি জঘন্য ভুল প্রচার। যে সাংবাদিকের কলম থেকে প্রথমে এই কথাটি বের হয়েছে আমি তার নাম জানতে চাই। তার শিক্ষার বহর আমি দেখতে চাই।

এপিসিওটোমী দেয়া হয় ভ্যাজাইনাল ডেলিভারীর সময়ে, যেটাকে হয়ত রোগীর অভিভাবক এইভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছে আর সাংবাদিক তাই তুলে ধরেছে। পেশেন্ট পক্ষের বহু কথা থাকে যা সম্পূর্ন অবৈজ্ঞানিক, মনগড়া। নিজের আত্মীয়স্বজনের মধ্যেই দেখেছি। তাদের কথা শুনে সাংবাদিকতা করা অন্যায়।

অথচ এই কথা দিয়ে এমন একটা ইমপ্রেশন দেয়া হয়েছে যে যারা ডেলিভারী করিয়েছে তারা সব ছিড়ে ফেড়ে পেশেন্টের এই দুরবস্থা করেছে। জনগনের রোষানল হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

পেশেন্ট কি অবস্থায় এসেছে তার খোঁজ না নিয়ে বা বিস্তারিত না লিখে চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় বাচ্চার মৃত্যু এবং মায়ের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে যে খবর ছড়িয়ে দিয়েছেন তা আর মোচন হয়নি।

পেশেন্টের স্বামী স্থানীয় ডাক্তারদের কথা উপেক্ষা করে একটি লেবারের পেশেন্টকে এতদূরে যে নিয়ে এসেছে তাতে পেশেন্ট এবং বাচ্চা উভয়েরই বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেবার কথা। তাহলে এত ঝুঁকি নিয়ে তাদের ঢাকায় আসার ফলাফল যে খারাপ হতে পারে এই প্রসঙ্গে কেউ আসেইনি। যারা এমন ঝুঁকিপূর্ন অবস্থায় পেশেন্টকে নিয়ে এসেছে এটি একটি অপরাধ। অত্যন্ত গুরুত্ত্বের সাথে এটাও বিবেচনা করতে হবে যে লেবার পেইনসহ পেশেন্টকে ঢাকায় আসার জন্য উদবুদ্ব কে করেছে? কেউ আহবান করে থাকলে সেটি একটি গুরুতর অপরাধ। অথচ সে বিষয়ে মোটেও আলোকপাত না করে সোজা শাহজাদী ও মুনার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

এখন আসা যাক পেশেন্ট ভর্তি করার পরে কে কি রোল প্লে করেছে।

ডা. মুনা একজন ডিউটি ডাক্তার। যাদের কাজই হোল হুকুম পালন করা। সে সঠিকভাবে হুকুম পালন করতে পারলে রোগীর জীবন মৃত্যুতে তার কোন দায় নেই।

ডা. শাহজাদী মূল ডাক্তার যে পেশেন্ট ম্যানেজ করেছে। সে দীর্ঘদিন ধরে এই ডেলিভারীর কাজ করে এসেছে এবং ডা. সংযুক্তা সাহার নির্দেশনাতেই করেছে। জটিলতা যে কোন সময়ে যে কারো হাতে হতেই পারে।

ডা. মিলি যে মধ্যরাতে নিজের আরাম বিসর্জন দিয়ে পেশেন্টের জীবন বাঁচাতে দৌড়ে এসেছে তারও বিন্দুমাত্র দায় নেই।

অথচ রোগীর অভিভাবকের নালিশের ভিত্তিতে মিডিয়ার ব্যাপক প্রচারনায় আজ নিরীহ চিকিৎসকরা হয়রানীর শিকার।

আপনারা জনগনের কথা বলেন। একজন ডাক্তারও জনগনের অংশ। যদি কেউ অন্যায় করে তার বিরুদ্বে সোচ্চার হউন আর নিরাপরাধীদের অন্যায়ভাবে শাস্তি দেয়া ও হয়রানীর বিরুদ্বেও সোচ্চার হউন।


আরও দেখুন: